ঢাকা মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

বিচ্ছিন্ন মানুষ পাচ্ছে না ত্রাণ

বার্তাজগৎ২৪ ডেস্ক

প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৪

বিচ্ছিন্ন মানুষ পাচ্ছে না ত্রাণ

‘পরিবার নিয়ে সড়কের ওপরে আছি। ঘরবাড়ি সব শেষ। অনেকে ত্রাণ নিয়ে আসে, ত্রাণ পাচ্ছি। কিন্তু এলাকার ভেতরে আমার বোন-ভাগনিরা আছে। তাদের কাছে কেউই যায় না ত্রাণ দিতে।’ কথাগুলো বলছিলেন কুমিল্লায় গোমতী নদীর বাঁধ ভাঙায় সড়কে আশ্রয় নেওয়া বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকার বাসিন্দা মতিন মিয়া।

মতিন মিয়ার মতো অনেকে অভিযোগ করেছেন, প্রত্যন্ত এলাকার অনেক পানিবন্দী মানুষের কাছেই গতকাল পর্যন্ত কোনো সহায়তা পৌঁছায়নি; বিশেষ করে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, নৌকার সংকটে ত্রাণ দিতে আসা লোকজন প্রত্যন্ত এলাকায় যেতে পারছেন না। সড়কের পাশে যাদের পাওয়া যাচ্ছে, তাদের মধ্যেই বারবার ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে।

এদিকে ফেনী ও নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও লক্ষ্মীপুরে অবনতি ঘটেছে। কুমিল্লায় গোমতীর পর এবার ভেঙেছে সালদা নদীর বাঁধ। এদিকে রাঙামাটিতে কাপ্তাই হ্রদের পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই। এই অবস্থায় কাপ্তাইয়ে জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৬টি স্পিলওয়ের গেট ৬ ইঞ্চি করে আজ সকালে খুলে দেওয়ার কথা রয়েছে। সিলেট অঞ্চলেও ধীরে ধীরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। পানি কমছে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে।

কুমিল্লায় ভেঙেছে আরেক বাঁধ
কুমিল্লায় গত দুদিনে বৃষ্টি হয়নি। তবে ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে গোমতীর পানি বিপৎসীমার ৯২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। গোমতীর ভাঙনে পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ পৌঁছেছে চরমে। ভেঙে পড়েছে যোগাযোগব্যবস্থাও। এদিকে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার দৌলতপুরে শুক্রবার রাতে পানির চাপে ভেঙেছে সালদা নদীর বাঁধ। এতে আরও ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর আগে বুড়িচংয়ের বুড়বুড়িয়ায় বৃহস্পতিবার রাতে ভাঙে গোমতীর বাঁধ। সব মিলিয়ে পুরো কুমিল্লায় এখন ১০ লাখের মতো মানুষ পানিবন্দী। বিদ্যুৎ না থাকায় ও খাদ্যসংকটে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। অনেক স্থানে নেই মোবাইল নেটওয়ার্কও।

পানিবন্দী এসব মানুষের কাছে ত্রাণসহায়তা দিতে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিপর্যায়ে অনেকে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু নৌকা কিংবা স্পিডবোট না থাকায় সেই ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না প্রত্যন্ত এলাকায়। এই অবস্থায় অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে অনেক পরিবারের। ব্রাহ্মণপাড়ার বাগড়া এলাকার বাসিন্দা মুসলেম মিয়া বলেন, ‘আমাদের এলাকায় সালদা নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। সবাই বাঁধ ভাঙা দেখতে আসে, কোনো সহযোহিতা করে না। অসহায় অবস্থায় আছি।’

বুড়িচংয়ে ত্রাণ দিতে আসা কুমিল্লার একটি ক্লাবের সদস্য মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘গ্রামের ভেতরে অনেক লোক আটকা আছে। নৌকা না থাকায় অনেকে সেখানে যেতে পারছেন না। আমরা চেষ্টা করছি। সবাইকে অনুরোধ করব কষ্ট করে হলেও গ্রামের ভেতরের মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য।’

বুড়িচং উপজেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক বাবু বলেন, নৌকার সংকটের কারণে ত্রাণ দিতে আসা মানুষ ভেতরে যেতে পারছে না। সড়কের পাশে একই জায়গায় বারবার ত্রাণ দিয়ে চলে যাচ্ছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম চলছে। বিভিন্ন ব্যাংক, এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছে। বুড়িচংয়ের অবস্থান এমন জায়গায়, সেখানে সহজে নৌকা আনা-নেওয়া কঠিন। তারপরও আমরা নৌকা আনার চেষ্টা করছি।’ এ ছাড়া সেনাবাহিনী, পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের লোকজন মাঠে কাজ করছেন বলেও জানান তিনি।

মাঝরাতে সড়কে ডাকাতির চেষ্টা
ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনীর লালপোল এলাকায় তীব্র স্রোতের কারণে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগ গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে বন্ধ রয়েছে। এতে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই পর্যন্ত আটকা পড়েছে কয়েক হাজার যানবাহন। নষ্ট হচ্ছে কাঁচা পণ্য। সময়মতো বন্দরের পৌঁছাতে পারছে না রপ্তানি পণ্য।

এর মধ্যেই কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে শুক্রবার রাতে যানবাহনগুলোয় ডাকাত-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় যানবাহনের চালকেরা একযোগে হর্ন বাজাতে শুরু করেন। এই শব্দে মহাসড়কের আশপাশের বাসিন্দারা ছুটে আসেন। পরে স্থানীয় বিভিন্ন মাইকে ঘোষণা দিয়ে আরও লোকজন জমা করা হয়। এরপর লাঠি হাতে রাতভর মহাসড়কে যানবাহন পাহারা দেন স্থানীয়রা।

সুমন মিয়া নামের এক ট্রাকচালক বলেন, ‘শুক্রবার দুপুর থেকে আমরা মহাসড়কের চৌদ্দগ্রামের বাতিসা এলাকায় আটকা পড়ি। রাত গভীর হলে ডাকাত দল হানা দেয়। এ সময় আমাদের হর্নের শব্দ শুনে স্থানীয়রা এগিয়ে এসে আমাদের রক্ষা করেন। রাতভর স্থানীয় যুবকেরা লাঠি নিয়ে আমাদের নিরাপত্তা দেন।’

চট্টগ্রামমুখী শিশু খাদ্যবাহী ট্রাকচালক শাহ আলম বলেন, ‘দুই দিন ধরে সড়কে কয়েক হাজার গাড়ি আটকা রয়েছে। কবে ছুটতে পারব জানি না।’ তিনি বলেন, ‘খাবারের কোনো সংকট নাই। সড়কের পাশে একদল যুবক আমাদের নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করে যাচ্ছেন।’

ফেনীর লালপোল থেকে ফিরে আসা যুবক সাকিব মিয়াজী বলেন, ‘লালপোলে মহাসড়কের ওপর দিয়ে হাঁটুপানি। পানির স্রোত সোনাগাজীর দিকে যাচ্ছে।’

এদিকে ফেনীর প্রত্যন্ত এলাকায়ও ত্রাণসহায়তা পৌঁছাচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তীব্র স্রোতের কারণে প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে বলে স্থানীয় সূত্র বলেছে।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, ‘লালপোল এলাকা দিয়ে মহাসড়কের ওপর দিয়ে প্রবল বেগে স্রোত বইছে। এ কারণে যানবাহন চলতে পারছে না।

নোয়াখালীতে উন্নতি, লক্ষ্মীপুরে অবনতি
নোয়াখালীতে সেনবাগ বাদে সদর, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর, বেগমগঞ্জ, চাটখিল ও সোনাইমুড়ী উপজেলায় গতকাল বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে সেনবাগের তিনটি ইউনিয়নে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এই জেলায় প্রায় ২১ লাখ মানুষ পানিবন্দী। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বানভাসি মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী অনেক সংগঠন। তবে এই জেলায়ও প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে ত্রাণসহায়তা পৌঁছাচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল দুপুরে সোনাইমুড়ীতে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।

এদিকে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় ব্যাপক খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। নলকূপগুলোর পানি অনেকে বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ছাড়া বা বিশুদ্ধ না করে পান করতে বাধ্য হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ উপদেষ্টা স্বীকার করেন, সময়মতো মানুষের কাছে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পৌঁছাতে স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যর্থ হয়েছে।

সুবর্ণচরের কাজল মার্কেট এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী হোসনেআরা বেগম বলেন, ‘শুধু পানি আর পানি। ৩০ বছরে এমন পানি দেখি নাই। উঠানে কোমরপানি। ঘরেও পানি। খাটের ওপর চটের বস্তা দিয়ে চুলা রেখে কোনোমতে রান্না চলছে। আশপাশের সবার একই অবস্থা। ঘরে টাকা নাই, বাজারও দূরে। কীভাবে সংসার চলবে জানি না। পানি না কমলে কাল থেকে না খেয়ে থাকতে হবে। নদীপারের মানুষের কী অবস্থা, আল্লাহ জানে।’

এদিকে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছেন, নোয়াখালীর বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ সংকটের অজুহাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা শুকনো খাবার, গ্যাস সিলিন্ডারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। ৬৫-৭০ টাকার মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকায়। প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডার ১৪৫০-১৫৫০ টাকার পরিবর্তে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকা হচ্ছে। এসব বিষয়ে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বা জেলা প্রশাসন থেকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। জেলা ভোক্তা অধিকারের সহকারী পরিচালক কাউসার মিঞা বলেন, তাঁরা কাজ করছেন। তবে বন্যার কারণে বাজারে যাওয়া যাচ্ছে না।

লক্ষ্মীপুরে শুক্রবারের চেয়ে বন্যার পানি আরও ২-৩ ফুট বেড়েছে। ৫টি উপজেলা, ৪টি পৌরসভা ও উপকূলের ৪০টি এলাকায় পানিবন্দী ৭ লাখ মানুষ। শুক্রবার বিকেল থেকে জেলার অনেক এলাকা বিদ্যুৎবিহীন। এতে মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন ত্রাণসহায়তা নিয়ে এগিয়ে এলেও তা অপ্রতুল। বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত নানা রোগবালাই।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, আখাউড়ায়ও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

চট্টগ্রামে কমলেও পার্বত্যে পানি বাড়ছে
দুদিন পর চট্টগ্রামের ১৬ উপজেলা থেকে পানি সরেছে। এখানে গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্যায় পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুজন বিদ্যুতায়িত হয়ে এবং একজন আতঙ্কে মারা গেছেন। চট্টগ্রামের ১৬ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফটিকছড়ি। ভেসে গেছে মাছের ঘের ও পুকুর, ডুবেছে ফসলের মাঠ। মুরগি ও গবাদিপশুর খামারগুলোও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এদিকে রাঙামাটিতে কাপ্তাই হ্রদের পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই। তলিয়ে গেছে শত শত ঘরবাড়ি। এমনকি ঝুলন্ত সেতুটিও ডুবেছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের বাঁধটির ১৬টি স্পিলওয়ের গেট আজ সকালে ৬ ইঞ্চি করে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। এতে প্রতি সেকেন্ডে ৯ হাজার কিউসেক পানি অপসারিত হবে বাঁধ থেকে। এ ছাড়া বর্তমানে ৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৩২ হাজার কিউসেক পানি অপসারণ করা হচ্ছে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এ টি এম আবদুজ্জাহের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় রুষা চাকমা (১১) নামের ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বন্যার পানিতে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। দীঘিনালায় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া বন্যার্ত ৩০০ মানুষের মধ্যে গতকাল শুকনো খাবার ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

পানি কমছে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে
মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির ধীরগতিতে উন্নতি হচ্ছে। বন্যাকবলিত এলাকা কমলগঞ্জ, রাজনগর, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা ও সদর উপজেলায় পানি কমছে। তবে বন্যাদুর্গত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যার্তদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। হবিগঞ্জের সব কটি নদ-নদীর পানিও বিপৎসীমার নিচে নেমেছে।

বার্তাজগৎ২৪

Link copied!