বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে বারবার সমালোচনার মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই অবস্থায় স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসিকে নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী করার ওপর অনেক দিন ধরেই জোর দিয়ে আসছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তা না করে উল্টো পথে হেঁটেছে নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। নিজের ক্ষমতা না বাড়িয়ে বিভিন্ন সময় উল্টো কমিয়েছে ইসি।
ইসির ক্ষমতা কমানোর সর্বশেষ নজির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন। এ সময় আরপিওর বেশ কিছু ধারা-উপধারায় সংশোধনী আনে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। তখন মূলত বিতর্কের সৃষ্টি হয় ৯১ ধারার (এ) উপধারা সংশোধন নিয়ে। এই উপধারা অনুযায়ী, নির্বাচনে ভীতি প্রদর্শন, বলপ্রয়োগ, চাপপ্রয়োগ বা বিরাজমান বিভিন্ন অপকর্মের কারণে ইসি যদি মনে করে, তারা আইনানুগ ও ন্যায়সংগত নির্বাচন করতে সক্ষম হবে না, তাহলে নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা রাখে। এই ক্ষমতাবলে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ করেছিল কমিশন। কিন্তু আরপিও সংশোধনকালে সেই ক্ষমতা কমিয়ে শুধু ভোটের দিন সংসদীয় আসনের (অনিয়মের কারণে) ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা রাখা হয়। সংশোধিত আরপিওর ৯১ ধারার (এ) উপধারায় ‘ইলেকশন’ শব্দের বদলে ‘পোলিং’ শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ‘ইলেকশন’ শব্দ দিয়ে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া বোঝায়।
অর্থাৎ তফসিল ঘোষণা থেকে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সময়টা হলো ‘ইলেকশন’। আর ‘পোলিং’ হলো শুধু ভোটের দিন; যার ফলে এই সংশোধনীর মাধ্যমে অনিয়মের কারণে ইসি শুধু ভোটের দিন সংশ্লিষ্ট ভোটকেন্দ্র বা পুরো সংসদীয় আসনের ভোট বন্ধ করতে পারবে।
বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তখন নিজের মতো ব্যাখ্যা দিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ইসি। এতে উল্লেখ করা হয়, অনুচ্ছেদ ৯১-এর (এ)-তে ‘ইলেকশন’ শব্দটি ‘পোলিং’ শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
এখানে কারেকশন হয়েছে। অ্যামেন্ডমেন্ট নয়। কারেকশন ও অ্যামেন্ডমেন্টের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পোলিং সার্বিক ইলেকশন-প্রক্রিয়ার একটি পর্যায়। এটিকে ক্ষেত্রভেদে সমার্থক ভাবা যেতে পারে। আবার বিভাজিত করেও ভাবা যেতে পারে। এই পরিবর্তন দিয়ে কমিশনের ক্ষমতার কোনো রকম হেরফের হওয়ার সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই কমিশন তো নিজেদের ক্ষমতা কমিয়েছেই; রকিবউদ্দীন কমিশনও (২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ) আরপিওর ৯১-এর (ই) উপধারা বাতিল করতে চেয়েছিল (এই উপধারায় প্রার্থী অনিয়ম করলে তাঁর প্রার্থিতা বাতিলের সুযোগ কমিশনের রয়েছে। পরে অবশ্য সেখান থেকে ফেরত আসে)। কমিশন স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। কমিশনকে সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করলে হবে না।
আগে সব সময় জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করতেন ইসি কর্মকর্তারা। কিন্তু গত সংসদ নির্বাচনের আগে এ জন্য আলাদা আলাদা কমিটি গঠন করে কমিশন। মহানগর ও জেলার জন্য গঠিত সাত সদস্যের কমিটিতে জেলা প্রশাসককে (ডিসি) আহ্বায়ক করা হয়। সদস্যসচিব করা হয় সিনিয়র জেলা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে। এ ছাড়া এই কমিটিতে পুলিশ সুপার, সংশ্লিষ্ট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারের উপযুক্ত একজন প্রতিনিধি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে সদস্য রাখা হয়েছে।
আর উপজেলা ও থানা পর্যায়ে ভোটকেন্দ্র-সংক্রান্ত কমিটিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) আহ্বায়ক করা হয়েছে। সদস্যসচিব করা হয়েছে উপজেলা ও থানা নির্বাচন কর্মকর্তাকে। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও অফিসার ইনচার্জকে সদস্য করা হয়। একইভাবে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার তালিকা তৈরির জন্যও মহানগর ও জেলায় ডিসি এবং উপজেলায় ইউএনওকে প্রধান করে কমিটি করার উদ্যোগ নিয়েছিল কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। যদিও পরবর্তী সময়ে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ইসি।
এ বিষয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দিয়ে এমন কাজ করানো উচিত নয়, যেগুলো দিয়ে নির্বাচন প্রভাবিত করা যায়, নির্বাচনের ফলাফলকে ভবিষ্যতে প্রভাবিত করার শঙ্কা থাকে। সেগুলোর ব্যাপারে সাবধান হওয়া দরকার। ভোটকেন্দ্রের দায়িত্ব পালনের জন্য গঠিত কমিটিতে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রধান করা নিয়ে তখন নানা যুক্তি দেখানো হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ আছে ইসির কর্মকর্তাদের মধ্যে।
তাঁরা বলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্যদের সঙ্গে যেভাবে যোগাযোগ রেখে নির্বাচন সম্পন্ন করেন, সেই দক্ষতা ইসির নির্বাচন কর্মকর্তাদের হয়নি, এমন অজুহাতে ইসির নিজস্ব জনবল থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।
অথচ গত সংসদ নির্বাচনের আগেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংসদ নির্বাচনে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিল। ইসির রোডম্যাপেও রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা যত দূর সম্ভব ইসির কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নিয়োগের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। তারপরও ইসির জনবল থেকে ওই নির্বাচনে কাউকে রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হয়নি। সংসদ নির্বাচনে ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। শুধু কোথাও ইউএনও না থাকলে সেখানে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ইসির জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়।
জনবল নিয়োগের বিষয়ে ইসির কর্মকর্তারা জানান, সংবিধানে ইসির ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মচারীর জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করলে তিনি তার ব্যবস্থা করবেন। উল্লেখ থাকলেও কমিশন যেন নিজের ক্ষমতা নিজেই বুঝতে অক্ষম। তাই যখনই নিজস্ব জনবলের প্রয়োজন হয়, সংস্থাটি সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে জনপ্রশাসনের কাছে প্রস্তাব পাঠায়। এতে সরকার যথারীতি ইসির প্রস্তাবিত জনবল থেকে কাটছাঁট করে লোকবল দেয়।
ইসি কর্মকর্তাদের মতে, রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকায় ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমেও নিজের ক্ষমতায় অন্যকে ভাগ দিয়েছে কমিশন। কারণ, রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকার জন্য যে বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেখানেও ইউএনওকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :