ঢাকা মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারি, ২০২৫

ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কে সুবাতাস

বার্তাজগৎ২৪ ডেস্ক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৪, ২০২৫

ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কে সুবাতাস

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেন। দীর্ঘ ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে  কূটনৈতিক সম্পর্কগুলো একটা চ্যানেলে চলত। এরমধ্যে ভারতের সঙ্গে হাসিনা সরকারের সম্পর্ক স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও উষ্ণতম ছিল, যা ৫ আগস্টের পর শীতল হতে থাকে। তবে বর্তমান সরকারের সময়ে অনেক দেশের সঙ্গে সম্পর্কের একটা ভারসাম্য আসতে থাকে। এর মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য।

এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা সফরে আসছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে আগামী মাসে তিনি বাংলাদেশ সফর করবেন। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তার এ সফরকে যুগান্তকারী বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের আসন্ন এই সফরটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ যা গত বছরের আগস্টে ভারতপন্থি সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ককেই সামনে তুলে ধরছে।

ঢাকা ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক সূত্রের দাবি, ৫ আগস্টের পর থেকেই বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। যদিও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করার একটা দাবি আছে। এ বিষয়ের বাইরে দুই পক্ষই চায় সম্পর্কের ভারসাম্য।

এরমধ্যে গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক  দার ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাংলাদেশ আমাদের হারিয়ে যাওয়া ভাই। বাংলাদেশকে সম্ভাব্য সব উপায়ে সহযোগিতা করবে পাকিস্তান। তিনি জানান, ২০১২ সালের পর পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটাই প্রথম বাংলাদেশ সফর হতে চলেছে। ইসহাক দার বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আমন্ত্রণে ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ঢাকা সফর করবেন।

এদিন ইসহাক দার সাংবাদিকদের সামনে প্রধান বৈদেশিক নীতির ঘটনাবলি এবং সরকারের অর্জন এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। পাকিস্তানের  পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসও পারস্পরিক সম্মত তারিখে ইসলামাবাদ ভ্রমণের জন্য পাকিস্তানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।

এর আগে ২০১২ সালে সর্বশেষ পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন হিনা রব্বানি খার। মূলত উন্নয়নশীল আট মুসলিম দেশের জোট ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে আমন্ত্রণ জানাতে সে সময় তিনি ঢাকা সফর করেছিলেন।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক সব সময়ই একটা সংবেদনশীল বিষয় ছিল। আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিগত অন্য সরকারগুলোর সময়ও সেটি অব্যাহত ছিল। ১৯৭১ সালের ইতিহাস বিবেচনায় এ নিয়ে আলোচনা ও রাজনীতি হয়েছে অনেক। তারপরও সম্পর্ক কিছুটা ভারসাম্যের দিকে চলছিল। কিন্তু গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের সময়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এর অন্যতম কারণ হলো যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রেক্ষাপট। ফলে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরই ড. ইউনূস সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ায় পাকিস্তান। এই সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে পাকিস্তান। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ৩০ আগস্ট ক্যামেরুনে ওআইসির সম্মেলনের ফাঁকে কথা বলেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব। এরপর বাংলাদেশে পাকিস্তানের হাইকমিশনারও দেখা করেছেন সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, গত কয়েক বছর ধরে তো পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক একটু শীতল যাচ্ছিল, পাকিস্তান সেটি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ বিষয়ে বলা হয়, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের মেয়াদে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কে টানাপড়েন ছিল। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত ও ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বেশ কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির অনুমতি দিয়ে পাকিস্তানি পণ্যের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞাও তুলে নিয়েছে। এছাড়া সমুদ্রপথে দুই দেশ সরাসরি বাণিজ্যও শুরু করেছে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে পাকিস্তান। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরনগরী করাচি থেকে একটি পণ্যবাহী জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করেছিল। ১৯৭১ সালের পর এটিই প্রথম কোনো পাকিস্তানি পণ্যবাহী জাহাজের বাংলাদেশে নোঙর করার ঘটনা। উভয় দেশের মধ্যে এই সরাসরি সমুদ্র সংযোগকে ঐতিহাসিক বলেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় সমুদ্রপথে ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে সরাসরি এই সংযোগে ভারতের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা নিয়ে প্রশ্নও আছে।

জানা গেছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বহু বছর দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্য হতো না। পরবর্তী সময়ে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আবার স্থাপিত হলেও পাকিস্তান থেকে সাধারণত সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রামে আসত না। সে দেশের পণ্যবাহী জাহাজ প্রথমে শ্রীলঙ্কায় কন্টেইনার খালাস করত। এরপর জাহাজ বদল করে সেসব কন্টেইনার বাংলাদেশে আসত। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সীমিত হতে থাকে। তখন নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে পাকিস্তান থেকে আমদানি করা অধিকাংশ পণ্য ‘লাল তালিকাযুক্ত’ করে এনবিআর।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের অনুরোধে গত ২৯ সেপ্টেম্বর লাল তালিকা থেকে মুক্ত হয়েছে দেশটির সব ধরনের পণ্য। তবে শুধু এক্ষেত্রে নয়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়নে আরও অনেক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবীর বলেন, সার্বিকভাবে দুদেশের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি ইতিবাচক। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও বলে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কোনো দেশের সঙ্গে একেবারেই ভারসাম্যহীন থাকা ঠিক নয়। ঢাকা-করাচি সম্পর্কের একটা ভারসাম্য হওয়া দুই দেশের জন্যই ভালো।

গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের মধ্যে বৈঠকের ঘোষণায়ও উল্লেখ করা হয় যেÑ দুই দেশই বিভিন্ন স্তরে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করেছে। আর এ সবের মধ্যে নতুন করে এই জাহাজ ভেড়ানোর খবর দুই দেশের সম্পর্কের উষ্ণতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

অবশ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপেও পাকিস্তানের রপ্তানি বেড়েছে। গত ২৬ ডিসেম্বর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য ডন। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ৯টি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বাণিজ্য ঘাটতি চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৪৭.৫৫ শতাংশ বেড়ে ৪.৪৭৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ৩.০৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল।

কায়রোয় ড. ইউনূস-শেহবাজ বৈঠক : গত ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। তিনি বলেন, ‘আমরা সত্যিই ভ্রাতৃপ্রতিম বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক জোরদার করার অপেক্ষায় আছি।’ ডি-৮ সম্মেলনের ফাঁকে মিসরের রাজধানী কায়রোর একটি হোটেলে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানো এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ জোরদার করতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। এ সময় দুই নেতা চিনিশিল্প এবং ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার মতো নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রসারের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস এবং শরীফ সার্কের পুনরুজ্জীবনসহ পারস্পরিক স্বার্থের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এ সময় ইউনূস তার সরকারের প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং ২০২৬ সালের মাঝামাঝি আগে সাধারণ নির্বাচন করার পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সংস্কারের বিষয়ে সংলাপ করার জন্য একটি ঐকমত্য তৈরিতে কাজ করছি। অধ্যাপক ইউনূস ঢাকা ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ১৯৭১ সালের সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো নিষ্পত্তি করার জন্য আহ্বান জানান। ইউনূস শরিফকে বলেন, ‘বিষয়গুলো বারবার আসছে। আসুন আমরা সেই বিষয়গুলো সমাধান করে সামনের দিকে এগিয়ে যাই।’

জবাবে শেহবাজ শরিফ বলেন, ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারত বিষয়গুলো মীমাংসা করেছে, কিন্তু যদি অন্যান্য অমীমাংসিত কিছু থেকে থাকে, তবে সেগুলো দেখা হবে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিষয়গুলো সমাধান করা হলে ভালো হবে।

বার্তাজগৎ২৪

Link copied!