বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমোদন চেয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আবারও আবেদন জানানো হয়েছিল। এমন আবেদন আগেও কয়েকবার করা হয়েছিল। প্রতিবারই সরকার তা নাকচ করেছে। এবারও খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে তাঁর দণ্ড ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। তাঁকে দেশেই চিকিৎসা নিতে হবে। এটা এখন স্পষ্ট যে, সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা না হলে বিএনপির প্রতি কোনো প্রকার নমনীয়তা দেখানো হবে না। সরকারের পতন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে না এলে বিএনপির ব্যাপারে সরকারের মনোভাব কঠোরই থাকবে। আন্দোলন করে সরকার পতনের সক্ষমতা যে বিএনপির নেই, এটা সরকার বোঝে। বিএনপি যত তর্জন-গর্জনই করুক, রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার উপায় তাদের জানা নেই। বিএনপিকে মাথা তুলতে না দেওয়ার জন্য যা যা কৌশল নেওয়া দরকার, সরকার তা নেবে এবং নিচ্ছে। খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়াও সরকারের একটি কৌশল। খালেদা জিয়া দেশের বাইরে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাবেন এবং বিদেশি মিত্রদের সহানুভূতি-সমর্থন আদায় করবেন, তেমন সুযোগ সরকার দেবে না।
দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এটাই যে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মতো রাজনৈতিক-সাংগঠনিক শক্তি বিরোধী দলগুলোর নেই। সরকার অবশ্যই চাপে আছে, কিন্তু সেটা বিরোধী দলের কাছ থেকে নয়। সরকারের চাপ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা এবং দেশে নীতি-নৈতিকতার রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা। সরকার যে বিএনপির প্রতি সদয় নয়, সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা থেকেও স্পষ্ট হয়েছে। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস-২০২৪ পালন উপলক্ষে ১৮ মার্চ তেজগাঁওয়ে দলীয় কার্যালয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশবাসী তাঁদের পক্ষে রয়েছে, কাজেই তাঁর সরকারের পতন ঘটানো এবং দেশকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, তারা (বিএনপি-জামায়াত) আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার স্বপ্ন দেখছে। তারা কীভাবে ভুলে যায় যে আওয়ামী লীগ সব সময় জনগণের পাশে থাকে। যার জন্য জনগণ তাঁদের বারবার ভোট দেয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি রমজান মাসে গরিব মানুষের মধ্যে ইফতারি বিতরণ না করে সরকারের সমালোচনা করে। নিজেরা ইফতারি খায় আর আওয়ামী লীগের গিবত গায়। আর কবে আওয়ামী লীগকে উৎখাত করবে, সেই স্বপ্ন দেখে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন এবং এর নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ইফতার পার্টি না করে সারা দেশে গরিবদের মধ্যে ইফতারি বিতরণ করছেন। দেশবাসীও আওয়ামী লীগকে বারবার সমর্থন করেছে। কারণ, তারা তাদের প্রয়োজনে আওয়ামী লীগকে সব সময় পাশে পেয়েছে।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘এই রমজান মাসে আমি সবাইকে বলব, আপনাদের আশপাশে যারা দরিদ্র সাধারণ মানুষ রয়েছে, তাদের পাশে দাঁড়ান এবং তাদের সহযোগিতা করুন। আমরা যেমন ইফতারি বণ্টন করছি, তাদের সহযোগিতা করছি, আপনাদেরও সেটা করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তব্যে কি রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার কোনো ইঙ্গিত আছে? একসময় রাজনীতির লক্ষ্য ছিল জনকল্যাণ। সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা কাজ করতেন। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। রাজনৈতিক দলের সব স্তরের নেতা-কর্মীরা এখন আগে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চান, তারপর সাধারণ মানুষ বা জনকল্যাণ! আওয়ামী লীগও কি প্রকৃত অর্থে আগের আওয়ামী লীগ আছে? কেউ হয়তো বলবেন, বর্তমান বাস্তবতায় আওয়ামী লীগকেও নীতি-কৌশল বদলাতে হয়েছে। আগের মতো বা আগের ধারায় আওয়ামী লীগ চললে দলটির তো জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা। বিষয়টি নিয়ে গভীর আলোচনা দরকার। নিশ্চয়ই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক দল কি শুধু হাওয়া অনুযায়ী চলবে, নাকি নতুন হাওয়া তৈরিরও চেষ্টা করবে?
প্রসঙ্গত ফিরে যেতে হয় আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং যিনি বাংলাদেশের রাজনীতির বটবৃক্ষ, সেই বঙ্গবন্ধুর কাছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সাধারণ মানুষের নেতা। রাজনীতির তাত্ত্বিক পণ্ডিত তিনি ছিলেন না। এক বা একাধিক বিষয়ে তিনি বিশেষ জ্ঞানী কিংবা বিশেষজ্ঞও হয়তো ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রজ্ঞাবান একজন রাজনৈতিক নেতা। তিনি মানুষকে বুঝতেন, বুঝতেন জনমনস্তত্ত্ব। মানুষের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করতে পারতেন। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের রসদ তিনি সংগ্রহ করতেন মানুষের কাছ থেকে।
শেখ মুজিবের রাজনীতি প্রাসাদ চক্রান্তের সূতিকাগারে জন্ম নেয়নি, ক্ষমতার প্রলোভনে পুষ্ট হয়নি। এই রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়েছে বঞ্চিত বাংলার সুদূর গ্রামাঞ্চলে, নীরব-নিভৃত পল্লিতে, প্রতারিত-শোষিত বাঙালির পর্ণকুটিরে। যে ক্ষমতার উৎস জনগণের সমবেত ইচ্ছায়, সহযোগিতায় ও সমর্থনে নিহিত, সেই সুপ্ত ক্ষমতার পুনর্জাগরণই মুজিব রাজনীতির মূলমন্ত্র।
মানুষের মুক্তির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর আজীবন নিঃস্বার্থ ত্যাগের দৃষ্টান্ত বিরল। তুলনাহীন অজেয় চরিত্র এবং বীর্যবান নেতৃত্ব তাঁর মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এই ত্যাগ ক্ষমতালোভীর লোকদেখানো ভান নয়, এই ত্যাগ গণকল্যাণে উদ্বুদ্ধ দরদি মনের আত্মবিলুপ্তির পরিচায়ক, এই ত্যাগ ন্যায়ের পক্ষে নির্ভীক গণনেতৃত্বের দুর্বার সংগ্রাম। এই নেতৃত্ব অত্যাচারী বর্বর সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদের দুঃসাহসিকতা।
বাংলাদেশের স্বল্প বিকশিত ধনিক শ্রেণি ও অন্য সুবিধাভোগীরা এত দিন ভেবেছিল, বঙ্গবন্ধু বুঝি তাদেরই লোক। ভেবেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে এ দেশের জনগণকে লুণ্ঠন করে নিজেদের মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে তারা ভুল বুঝেছিল। বঙ্গবন্ধুর মনে আপামর জনগণের কল্যাণ কামনা ছাড়া আর কোনো চিন্তাই কখনো স্থান পায়নি। এ কথা ঠিক, ১৯৫০-এর দশকে অথবা ১৯৬০-এর দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হয়তো এই ধারণা পোষণ করতেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি পুঁজিবাদী শক্তির সহায়তায় বাংলাদেশকে পাকিস্তানি অধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করা যাবে। এ কারণে হয়তো তখনকার দিনের বামপন্থীরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা পোষণ করলেও তিনি বরং জনগণের কল্যাণ কামনা দ্বারা পরিচালিত হয়ে প্রগতির পথে এগিয়ে গেলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীলরা অন্য এক দিক দিয়ে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু করে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে একটা দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর প্রতিক্রিয়াশীলরা দেশকে ক্রমিক অবনতির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। দেশপ্রেমিক জনগণ এখন জানতে চাইছে—কী ছিল বঙ্গবন্ধুর মনে, কী ছিল তাঁর চিন্তাধারা, কী ছিল তাঁর কর্মনীতি ও কর্মপদ্ধতি। কারণ দেশপ্রেমিক জনগণ এখন বুঝতে পেরেছে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাধারণ মানুষের কল্যাণকামী রাজনীতিবিদ। তাঁর দল তারই কন্যার নেতৃত্বে টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলেও দেশে বৈষম্য বাড়ছে, দুর্নীতি বাড়ছে। স্বাধীনতা অর্জনের ৫৪ বছরের মাথায় এসে আমাদের বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আদর্শের প্রতি মনোযোগ দেওয়া জরুরি কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকার সেই কাজটি করলে নিঃসন্দেহে প্রশংসিত হবে।
লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক; চেয়ারম্যান, বিএফডিআর
আপনার মতামত লিখুন :