ফসলের শত্রু বালাই। বালাই নাশ করতে, অর্থাৎ মারতে ফসলের খেতে প্রয়োগ করা হয় বালাইনাশক। বহু রকমের বালাইনাশক থাকলেও দেশে বেশি ব্যবহৃত হয় রাসায়নিক কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক। বালাই নাশ করতে বালাইনাশক ব্যবহার করা হলেও তা শুধু বালাই বা ক্ষতিকর রোগজীবাণু ও পোকাই নয়, অনেক উপকারী জীব এমনকি মানুষকেও মেরে ফেলছে। প্রতিবছর দেশে অনেক মানুষ আত্মহত্যা করছে বিষাক্ত কীটনাশক খেয়ে। আর কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় অসুস্থতার কথা যদি ধরা হয়, তাহলে সেখানে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই, আছে ভোগান্তির চিত্র।
নির্বিচারে অতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশদূষণ বাড়ছে। তরল বালাইনাশক স্প্রে করার কারণে বাতাস দূষিত হচ্ছে, ফসল দূষিত হচ্ছে। দানাদার বালাইনাশক ছিটানোর ফলে সেই সব খেতের মাটি ও পানি দূষিত হচ্ছে। এর ফলে সেই সব খেতের মধ্যে থাকা বিভিন্ন জীব-জীবাণু মরছে, মাটিতে বসবাসকারী কেঁচোসহ অনেক উপকারী জীব মরে যাচ্ছে। পানিদূষণের কারণে সেই সব পানিতে ব্যাঙেরা ডিম পাড়লে তা ফুটছে না, ফুটে ব্যাঙাচি জন্মালেও সেগুলো মরে যাচ্ছে। অথচ ধানখেতের অধিকাংশ পোকা ব্যাঙেরাই খেয়ে কমিয়ে রাখে। ব্যাঙ কমে যাওয়ায় শত্রু পোকার সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। এতে ফসলের ক্ষতিও বাড়ছে। সেই ক্ষতি দেখে কৃষকেরা মাথা ঠিক রাখতে না পেরে বারবার বিষাক্ত বালাইনাশক খেতে দিচ্ছেন। কিন্তু এতে কাজের চেয়ে অকাজ বেশি হচ্ছে। অর্থাৎ, যে খেতে যত বেশি কীটনাশক দেওয়া হচ্ছে, সেই খেতে তত বেশি ক্ষতিকর পোকার উপদ্রব বেড়ে যাচ্ছে। কেননা, সেই সব ক্ষতিকর পোকামাকড় প্রাকৃতিকভাবে দমিয়ে রাখতে পারে যেসব জীব, তারা কীটনাশক প্রয়োগ করার কারণে মরে যাচ্ছে।
ফসলের বালাইয়ের মধ্যে বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড় উল্লেখযোগ্য। এর আক্রমণে প্রতিবছর এ দেশে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়। তাই কৃষকেরা তাঁদের কষ্টার্জিত ফসল বালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে নির্বিচারে বিষাক্ত বালাইনাশক প্রয়োগ করেন। প্রতিবছর এ দেশে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টন বালাইনাশক আমদানি করা হয়, যার অধিকাংশ ব্যবহার করা হয় ফসল চাষে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং জানিয়েছে, বিগত ২০২১-২০২২ অর্ধবছরে প্রায় ৪২ হাজার টন বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮ থেকে ১০ হাজার টন কার্বোফুরান-জাতীয় কীটনাশক। দেশে ব্যবহৃত বালাইনাশকের মধ্যে কার্বোফুরান-জাতীয় কীটনাশক সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এটি বর্তমানে অধিক ক্ষতিকর এবং পরিবেশ দূষণকারী জনস্বাস্থ্যের পরিপন্থী কীটনাশক হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় বিশ্বের ৮৭টি দেশে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পড়শি দেশ ভারত, নেপালেও এই কীটনাশক নিষিদ্ধ। এ দেশেও সরকারের কাছে এটি মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর কীটনাশক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় ২০২৩ সালের জুন থেকে এর আমদানি, ব্যবহার ও উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পরিবেশ দূষণকারী এসব বালাইনাশক প্রয়োগের কারণে আসলে ক্ষতিটা কী হচ্ছে? বিষাক্ত ক্ষতিকর এসব বালাইনাশক ব্যবহারের কারণে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ভারসাম্য হারাচ্ছে। এতে ফসলের খেতে পরাগায়নকারী পোকার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যেসব বান্ধব পোকা ও মাকড়সা শত্রু পোকাদের নানাভাবে দমন করত, তারা কমে যাচ্ছে। একটা লেডি বিটল দিনে ৩০ থেকে ৪০টি জাব পোকা খেয়ে কমাতে পারে। তাই একটা শিমের ডগায় যদি ৫০টা জাব পোকাও থাকে আর সেখানে যদি একটা লেডি বিটল ও তার বাচ্চা থাকে, তবে ওরা দু-চার দিনের মধ্যেই সব জাব পোকা খেয়ে ফেলতে পারে। অথচ প্রকৃতির এই বিধান অমান্য করে কৃষকেরা নির্বিচারে কীটনাশক স্প্রে করে যাচ্ছেন। এতে ক্ষতিকর পোকাদেরও কীটনাশকের প্রতি ধীরে ধীরে সহনশীলতা গড়ে উঠছে। দানাদার কীটনাশক দেওয়ায় ফসলের খেতে মাটিতে বাস করা উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও কেঁচোর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এরা মাটির উর্বরতা বাড়াতে সাহায্য করে। এতে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। কীটনাশক মেশানো দূষিত পানিতে ব্যাঙ-ব্যাঙাচি ও অন্যান্য জলজ জীবের পাশাপাশি অনেক দেশি মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এতে মশা বাড়ছে। সর্বোপরি পরিবেশে জীবজগতের খাদ্যশৃঙ্খলে বিশৃঙ্খলা নেমে আসছে। দূষিত পানির বিষাক্ত মাছ খেয়ে মাছরাঙারা মরে যাচ্ছে, বিষাক্ত পোকামাকড় ও ফসল খেয়ে অনেক পাখি মরে যাচ্ছে। বালাইনাশক ব্যবহারকারী তো বটেই, আমরা যারা বালাইনাশক প্রয়োগ করা ফসল খাচ্ছি, তারাও সেই বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছি। দিনে দিনে বাড়ছে আমাদের স্বাস্থ্য ও মৃত্যুঝুঁকি। কার্বোফুরান কীটনাশক একবার কোনো ফসলে প্রয়োগ করার পর তার অবশেষ ক্রিয়া থাকে ৩০ থেকে ৬০ দিন। এর মধ্যে কতবার যে কত ফসল তুলে তা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে!
ফিড দ্য ফিউচারের এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০১০ সালে ফসলে সব ধরনের বালাইনাশকের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। এর মধ্যে শুধু কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ২০ গুণ। বালাইনাশকের মধ্যে কীটনাশক তুলনামূলকভাবে বেশি বিষাক্ত, যা পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ফসলের মধ্যে ধানে সবচেয়ে বেশি বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়, এরপর সবজিতে। সবজির মধ্যে বেগুন, শিম, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু ইত্যাদিতে বেশি কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, বেগুনচাষিদের ৯৮ শতাংশ কৃষকই বালাইনাশক ব্যবহার করেন, কোনো কোনো কৃষক প্রায় প্রতিদিনই বেগুন ফসলে বালাইনাশক প্রয়োগ করেন, এক মৌসুমে বেগুনে কীটনাশক প্রয়োগের সর্বোচ্চ সংখ্যা পাওয়া গেছে ১৪০ বার। বিশ্বব্যাংক ই-লাইব্রেরিতে ২০১৩ সালে প্রকাশিত অন্য একটি গবেষণাপত্রে দেখা যায়, এ দেশে প্রায় ৪৭ শতাংশ কৃষক মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক প্রয়োগ করেন। অতিমাত্রায় রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
সবজি ফসলে অতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহার ও ব্যবহৃত কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ সবজিতে থেকে যাওয়ার বিষয়টি একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে। যেমন ২০১৬ সালে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির এক পরীক্ষায় শীতকালীন সবজি ফুলকপিতে মানবদেহে সহনীয় মাত্রার ৩৬ গুণ বেশি কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এ দেশে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার এপিডেমিওলজি বিভাগের ‘ক্যানসার রেজিস্ট্রি রিপোর্ট: ২০১৫-১৭’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রতিবছর হাসপাতালটিতে যত রোগী ভর্তি হয়, তাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সাধারণ কৃষক। এ ছাড়া ক্যানসার শনাক্ত করা ব্যক্তিদের মধ্যে কৃষকের হার এখন দিনে দিনে বাড়ছে। ভারতের পাঞ্জাবের কৃষক জারনাইল সিংয়ের আবেদনে সাড়া দিয়ে সেখানকার পোস্টগ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের গবেষকেরা ২০১৮ সালে এক অনুসন্ধান শুরু করেন। তাঁরা দেখতে পান, যেসব এলাকার কৃষকদের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে, ক্যানসারের প্রাদুর্ভাবও সেসব এলাকায় অনেক বেশি। বাংলাদেশেও বিগত চার দশকে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। পরিবেশ রক্ষা ও জীবন বাঁচাতে ফসল চাষে এখন বালাইনাশক ব্যবহার বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। রাসায়নিক বালাইনাশক ছাড়াও বালাই নিয়ন্ত্রণে বিকল্প আছে অনেক, সেসব বিষয়ে কৃষকদের দ্রুত সচেতন করা দরকার।
লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক
আপনার মতামত লিখুন :