করোনার অভিঘাত শেষ হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ৪০-৫০ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ১ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে থাকে। সেই মূল্যস্ফীতি গড়ে ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে; ইউরোপের কোনো কোনো দেশে তা ২০/২২ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। এমনকি তুরস্ক ও আর্জেন্টিনায় তা ৭০ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। এই যখন অবস্থা তারই মধ্যে লোহিত সাগরে হুতিদের বিরুদ্ধে একযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আগ্রাসন সারা বিশ্বের পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় বিরাট প্রভাব ফেলে। তার পর ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর আগ্রাসন চলমান রয়েছে। এমতাবস্থায়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পূর্বাভাস দিয়েছে ২০২৪ সালেও সারা বিশ্বে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকবে। আমদের দেশেও দ্রব্যমূল্য কিছুটা বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়েছে বলেই দ্রব্যমূল্য লাগামহীনভাবে বাড়তে পারে নাই। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক অবস্থায় গড়ে ৫/৬ শতাংশের মধ্যে থাকতো। আজ বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও তা ১০-এর নিচে রাখতে সক্ষম হয়েছে সরকার। এর অন্যতম কারণ হলো অভ্যন্তরীণ বাজারে কোনো না কোনোভাবে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখা। আর এই কাজটি করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর এর পেছনে কাজ করছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। বর্তমান বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীকে এই সংকটেও স্থিরতা ও তৎপরতার সঙ্গে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। শুধু তৎপরতা নয়, প্রতিমন্ত্রী বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন বলেই মনে হচ্ছে।
সম্প্রতি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর একটি কথা অনেকের নজরে এসেছে। কিছুদিন আগে একটি প্রোগ্রামে ব্রিফিং কালে তিনি বলেন, মৌসুমি কৃষি পণ্যের মজুদে ‘বাফার স্টক’ সরবরাহ করবে সরকার। এই বাফার স্টক শব্দ যুগল নতুন মাত্রা যোগ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ ভোক্তাশ্রেণির আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে বাফার স্টক নিয়ে। বাফার স্টক বলতে কী বোঝায়? বাফার স্টক হল, বাজার স্থিতিশীল রাখতে পণ্য মজুত রাখার কৌশল। এ কৌশলে পণ্যমূল্য যখন কম থাকে, সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য কিনে মজুদ করে রাখে। সরবরাহ কমে গেলে বাজারে যখন দাম বাড়তে শুরু করে, তখন ওই মজুদ পণ্য বাজারে বিক্রি করে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। বাফার স্টক পদ্ধতি চালু হলে বাজার ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেটের প্রভাব কমে আসবে। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করেন নাই। তিনি ভিন্ন পদ্ধতি আনয়নের মাধ্যমে সিন্ডিকেটের অচলায়তনে আঘাত করবেন। এটাই একজন উদ্ভাবনী মানুষের কাজ; আর সেই কাজটা করে চলেছেন তিনি।
নতুন নতুন পদ্ধতিতে সিন্ডিকেটকে আঘাত করার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে স্বল্প আয়ের মানুষকে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। সারা দেশে ১ কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে টিসিবির পক্ষ থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দেওয়া হচ্ছে। টিসিবির কার্ডধারীদের অনেকের লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য সংগ্রহ করতে কষ্ট হয়ে যায়। তাই তাদের অনেকের দাবি ছিল, নির্দিষ্ট দোকান খুলে দেওয়া যেখান থেকে কার্ডধারীরা যাতে যে কোনো সময় পণ্য সংগ্রহ করতে পারে। সে দিক বিবেচনা করে প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আগামী নির্দিষ্ট দোকান থেকে কার্ড দেখিয়ে পণ্য কিনতে পারবে টিসিবি কার্ডধারীরা। আজ বৈশ্বিক সংকটেও বর্তমান সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে নতুন নতুন উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। অথচ যখন বৈশ্বিক সংকট ছিলো না তখনকার পত্রিকার পাতা এখনো কাতর দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই সময় মানুষের জীবন অসহায়ত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। অমানবিক জীবনের সেই গল্পগুলো পড়তে গিয়ে চোখের কোণের পাশাপাশি সিক্ত হয়ে ওঠে হৃদয়ের করিডোর। ১৯৯১ সাল, তখন বিএনপি ছিল ক্ষমতায়। ১৪ অক্টোবর ১৯৯১ তারিখে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার ৫ পৃষ্ঠায় ‘৫ টাকায় কন্যা সন্তান বিক্রি’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। অভাবের কারণে পিতা তার নবজাতক কন্যা শিশুকে মাত্র ৫টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলায়। ১৯৯৪ সালের ৯ জুলাইয়ে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার ১ম পাতায় ‘বিলকিস বলেছে ‘আমার ববিকে আমি নিজেই খুন করেছি’ ।। সন্তানের চোখ আর কিডনি বেঁচে খেয়ে পরে বাঁচতে চেয়েছিল মা’ –শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ঘটনাটি ঘটেছিল রংপুর শহরের কামার পাড়ায়। মা বিলকিস বেগম ৩ বছরের কন্যা সন্তান ফারজানা ববিকে গলা টিপে হত্যা করেছিল। তার পর ব্লেড দিয়ে চোখ তুলে নিয়েছিল। পরবর্তীতে কিডনি তোলার সময় জনতার হাতে সে ধরা পড়েছিল এবং তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছিল। ভালোভাবে খাওয়া-পরার জন্য আর নিজের অসুখের চিকিৎসা করাতে মা বিলকিস বেগম এই ঘটনা ঘটিয়েছিল। পত্রিকার পাতা খুললেই কোনো না কোনো অমানবিক গল্পের সাক্ষী হতে হতো বাংলাদেশকে। সেই অমানবিক বাংলাদেশের চৌহদ্দি পেরিয়ে আজ আমরা মানবিক বাংলাদেশের বিনির্মাণ দেখতে পাচ্ছি।
আজ যখন বিএনপি নেতৃবৃন্দের মুখে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে কথা শুনি তখন মনে হয় তাদের সময় দ্রব্যমূল্যের কখনো বৃদ্ধি ঘটে নাই। এজন্য তারা দায়হীনভাবে সরকারের সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু তাদের সময়ের পত্রিকাগুলোর সংবাদ ভিন্ন কথা বলে। ১৯৯১ সালের ৯ জুলাইয়ে ইত্তেফাক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ‘এক লাফে ১০টাকা’ শিরোনামে একটা সংবাদ ছাপা হয়েছিল। যেখানে দেখা যায়, বাজেট ঘোষণার পূর্বে সয়াবিন তেলের দাম ছিল ২৮ টাকা। বাজেট ঘোষণার পরদিন এক লাফে উহা ৩৮ টাকায় পৌঁছে। এক মাসের ব্যবধানে তা ৪৮ টাকায় পৌঁছায়; সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি পায় ৭০ শতাংশের উপরে। ছয় মাসে লবণের দাম ৫/৬ টাকা থেকে বেড়ে ১০ টাকা হয়েছিল। লবণের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল ৫০ শতাংশের উপরে। এভাবে বিএনপির আমলে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এক আমলে কয়েক দফায় বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার সম্পূর্ণভাবে উদাসীন ছিল এবং কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
এরপর ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেও দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে সরকার পরিচালনা করেছিল বিএনপি-জামাত জোট। সে সময়ের প্রতিচিত্রও এসবের চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল না। আর তার ফিরিস্তি তুলে ধরতে গেলে লেখার কলেবর বেড়ে যাবে। সেটা হয়তো অন্য কোনো সময় লেখা যাবে। তাই সে দিকে না গিয়ে আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার হবে জনগণের কল্যাণের জন্য। সরকারে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা তাদের জায়গা থেকে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে কাজ করবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের মন্ত্রীরা সেই দায়বদ্ধতা রেখে কাজ করে যাবে বলেই প্রত্যাশা রাখি।
লেখক: আনিসুর রহমান মোল্লা
আপনার মতামত লিখুন :