সময়টা ২০০০ সালের কোরবানির ঈদের সময়ের। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণী শিক্ষার্থী, দরিদ্র কৃষক বাবার পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় প্রকৃতিগতভাবে বয়সের চেয়ে অনেক বেশি পরিণত। সেই বছরের আরো দুই বছর আগে মানে ১৯৯৮ সালে আমি তখন তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী, তখন সবে মাত্র আমার দাদার বাড়ির যৌথ পরিবারের ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে, আমার বাবা আমার দাদার কাছ থেকে পেয়েছিলেন ৫ কেজি চাল এবং কিছু আসবাবপত্র। নিজেদের কৃষি জমিতে চাষ করবে এমন কোন জমি বাবার হাতে ছিল না, মানুষের বাড়িতে কাজ করলে তখনকার সময়ে দৈনিক মজুরি হিসেবে পাওয়া যেত ৫০ টাকা সেই টাকাটা আমার অসুস্থ ভাই বোনদের এবং মায়ের ওষুধ কিনতেই শেষ হয়ে যেত। তবুও কোনরকম টেনেটুনে চলছে সংসার, কুড়িয়ে আনা শাক ভাজি কিংবা যে কোন একটা সবজি দিয়ে কিছু একটা রান্না করে রাখলেই থালা ভর্তি মোটা চালের ভাত নিমিষেই শেষ করে দিতে পারতাম তীব্র ক্ষুধার তাড়নায়।
ঠিক সেই সময়ে আমাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগ হলো নতুন একটি সদস্য, সেই সদস্য ছিল একটা টকটকে লাল গরু। আমাদের পাড়ার এক বিত্তবান মানুষ আমাদেরকে কিনে দিয়েছে লালন-পালন করার জন্য, কয়েক বছর লালন পালন করে ক্রয় করা টাকা বাদ দিয়ে যে টাকা লাভ হবে সেটার দুই ভাগের এক ভাগ পাবে আমার পরিবার।
আমি তো অনেক খুশি! প্রতিদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে সবুজ ঘাস কেটে আনতাম আমাদের গরুর জন্য, বিকেলে আবারও, খাবার খাওয়ানো এবং যত্ন নেওয়ার কারণে এভাবেই দিনের পর দিন আমাদের মধ্যে গড়ে উঠতে লাগলো একটা গভীর সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের কোন নাম নেই, স্বীকৃতি নেই, মুল্য নেই আমাদের সভ্য সমাজে।
৪-৫ মাস যেতেই আমার পায়ের আওয়াজ পেলেই গরুটি বুঝতে পারত আমি আসছি, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই এক দৌড়ে গিয়ে প্রতিদিন গোয়াল ঘর পরিষ্কার করতে আসতাম, জল খাবার এবং ঘাস দিয়ে আসতাম, কৃতজ্ঞতায় গরুটির চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো, খাবারে মুখ দেয়ার আগেই তার জিহ্বা দিয়ে আমার হাত চেটে দিত, আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম, মাঝে মাঝে গোসল করিয়ে দিতাম, গোয়াল ঘর থেকে বের করে ফসলশূন্য মাঠে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যেতাম।
এভাবে দিনে দিনে আমাদের মধ্যে একটা আকাশচুম্বী হৃদয়ের বন্ধন তৈরি হল, সেই সময় দৈনন্দিন জীবনে যা কিছু করি না কেন আমার ভালবাসার একমাত্র প্রাণীটি ছিল আমাদের গোয়াল ঘরের সেই গরুটি।
এভাবে দুই বছর লালন পালন করার পর, ২০০০ সালের যখন কোরবানির ঈদের আগে আমাদের গরুর অর্থের যোগান দাতা এবং আমার পিতা-মাতা নিশ্চিত হল এই গরুটি বন্ধ্যা, তারা আশা করেছিল প্রতিবছর এই গরুটি একটি করে বাচ্চা দেবে, সেই বাচ্চা যখন দেবেনা তারা নিশ্চিত হলো তখন সকলেই মিলে সিদ্ধান্ত নিল এবারের কোরবানির ঈদে গরুটিকে বিক্রি করে দেয়া হবে।
তখনও কিন্তু আমি পাঠ্য বইয়ে শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পটি পড়িনি, রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকও দেখিনি, কিন্তু আমার জীবনে ঘটে গেল সেই মহেশ গল্পের চেয়েও ভয়ংকর ট্রাজেডি, যার কোন কিছুই আমি স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারিনি।
ঈদের ১০ দিন আগে থেকে বাবা-মা নির্দেশ দিল আরো বেশি বেশি করে ঘাস আনতে, কারণ সেই গরুটিকে খাবার খাইয়ে মোটাতাজা করতে হবে যাতে করে ভালো বাজার মূল্য পাওয়া যায়, আমি অনেকভাবে বলার চেষ্টা করলাম বিক্রি না করে রাখা যায় কিনা, কিন্তু বাবা মা জানিয়ে দিল এটা একেবারেই অসম্ভব, আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ, গরুর জন্য দূরের কথা আমাদের জন্য ১০ টাকার খাবার কিনে আনবে সে সামর্থ্য ও ছিল না আমার পিতা-মাতার।
এরই মধ্যে হাজার দেড়েক টাকা ঋণ হয়ে গেছে, পাওনাদারেরা সেই টাকা আমার মায়ের কাছে খুঁজতে আসে, সেই দৃশ্যের প্রতিদিনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি নিজে, সেই টাকাটা দেওয়ার জন্য হলেও খুব দ্রুত গরুটা বিক্রি করা আমাদের ও খুব প্রয়োজন।
অন্যদিকে গরুর অর্থের যোগানদাতা মালিক বলে দিয়েছে তাদের টাকার দরকার, তাই এই গরুটি বিক্রি করে আমাদেরকে আরও একটি ছোট গরু কিনে দেওয়া হবে।
ঈদের মাত্র আর ৪-৫ দিন বাকি, গরু নিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমি এবং আমার বাবা বাজারে যাই, বাজারে যাওয়ার আগেই গরুর অনেক সুস্বাদু খাবার মিলছে, অতিরিক্ত যত্ন মিলেছে, আগে মাসে একবার গোসল করা হলেও এখন প্রতিদিন গোসল করানো হচ্ছে, তেল মালিশ করা হচ্ছে, এই সব দৃশ্য দেখে আমার বুকের ভিতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেত, কারণ গরু না বুঝলেও আমি তো বুঝতাম এটা তার মৃত্যু যাত্রা।
অবশেষে ঈদের দুই দিন আগে আমাদের স্থানীয় বাজারে নেওয়ার সময় পথের মধ্যে এক কাজী সাহেবের ছেলে বাইক থামিয়ে আমাদের গরুটি কিনে নিল, ন্যায্য দাম পাওয়ায় বাবা অনেক খুশি হলো! কাজী সাহেবের বাড়িতে গরুটি দিয়ে আসার সময় বাবা গরুটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আমি তো গরুটিকে স্পর্শ করতে পারছি না, চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে, গরুটির দুই চোখের জলের দৃশ্য আমাকে চুরমার করে দিচ্ছে, আমরা যখন কাজী বাড়ির ভিটা ছেড়ে চলে আসছি, গরুটি তীব্র চিৎকার দিয়ে হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে, বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে তোকে আরেকটা গরু কিনে দেবে। আমি কিছুতেই বোঝাতে পারছি না আমার আরেকটা গরুর প্রয়োজন নেই, যদি কোনদিন পৃথিবীতে আমার গরুর প্রয়োজন হয় তাহলে সেই গরুটিকেই আমার লাগবে।
সেই সময়কার গরু বিক্রির ১৭০০০ টাকার সংখ্যাটা আমার কাছে মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর একটা সংখ্যা, এই সংখ্যার টাকাটা যদি সেদিন আমার হাতে থাকতো তাহলে আমি আমার কাছে রেখে দিতে পারতাম আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় আদরের গরুটা।
ঈদের দিন ঈদের নামাজের মাঠে মোল্লা সাহেব নবী ইব্রাহিমের এবং ইসমাইলের বিসর্জনের ঘটনা বলছে, সেই ঘটনায় অনেকের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে! সকলের চোখে জল গড়িয়ে পড়লেও আমার কেবল ইসমাইলের পরিবর্তে জবাই হওয়া পশুটার কথাই মনে পড়ছিল!
সেদিন মোল্লা সাহেব বলেছিলেন, ইব্রাহিমের তরবারিতে যদি ইসমাইল জবাই হয়ে যেত, তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত আমাদের পিতাদের হাতে সন্তানরাই জবাই হতাম। তখন সেই শব্দটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছিল, নিজের মনের মধ্যে এই কথাটা ভাবতেই আনন্দ হচ্ছিল, কত না ভালো হতো যদি আমার বাবার হাত আমি জবাই হতাম!
আজকে যে আমি তীব্র কষ্ট পাচ্ছি আমার আদরের গরুটার জন্য, সেই কষ্ট থেকে আমি মুক্তি পেয়ে যেতাম, এই ধরনের হরেক রকম চিন্তা আমার মাথায় আসার মধ্যেই শেষ হয়ে গেল কোরবানির ঈদের নামাজ, সবাই গরুই জবাই নিয়ে ব্যস্ত, যারা কোরবানি দিচ্ছে তাদের মুখে চাঁদের হাসি! যারা কোরবানি দিতে পারছে না তারা যেন মুখ লুকিয়ে বাঁচে!
চার পাঁচ জন মানুষ যখন অসহায় গরুটাকে নিষ্ঠুর ভাবে ফেলে জবাই করে তখন আমার ভেতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়, সেই দিন আমি ঈদের নামাজের পরে দৌড় দিলাম কাজী বাড়ির দিকে, আমাদের বাড়ি থেকে কাজী বাড়ি যেতে ৩০ মিনিটের মতো সময় লাগতো, গিয়ে দেখলাম তাদের উঠোনে মানুষের জটলা, কেউ খিলখিল করে হাসছে, কেউ পান চিবোতে চিবোতে বলছে আপনারা গরু কিনে জিতছেন! ভাজা (বন্ধ্যা) গরু তাই মাংস হয়েছে আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি!
আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখলাম, ভেতরে ঢোকার সাহস আমার হলো না, চোখ মুছতে মুছতে আবারো ফিরে আসলাম নিজের বাড়ির দিকে, আসরের নামাজের পরে আবারো গেলাম কাজী বাড়ির দিকে, গিয়ে দেখলাম চামড়া ঝুলিয়ে রেখেছে দেওয়ালের সঙ্গে, তেমন মানুষ জন নাই, একটা কুকুর আমার প্রিয় গরুর হাড্ডি চিবিয়ে অনেক মজা পাচ্ছে। যেখানে জবাই হয়েছে সেই জায়গাটায় রক্তের দাগ লেগে আছে, অনেকটা শুকিয়ে যাওয়া সেই রক্ত আমার হাত দিয়ে স্পর্শ করে ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করলাম, প্রাচীরের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা চামড়ায় হাত বুলিয়ে দিলাম, দূর থেকে দেখলাম তাদের পেয়ারা গাছে আমার গরুর শিং ঝুলছে, লিচু গাছে রেখে দিয়েছে দাঁতের পাটি। হাতে রক্তের দাগ নিয়ে ফিরে এলাম নিজেদের বাড়ির মসজিদের কাছাকাছি, মাগরিবের আজান হলো, সবার সঙ্গে নামাজ আদায় করে মোনাজাতে হাত তুললাম, নিজের অজান্তেই হাউমাউ করে কান্না চলে আসলো, পাশে থাকা আমার গ্রামের তখনকার সময়ের প্রিয় বন্ধু আমাকে বলল, তোদের কোরবানি দিতে পারেনি সেজন্য তুই মন খারাপ করে কান্না করছিস! মন খারাপ করবি না, সব আল্লার ইচ্ছা!
মোনাজাতে হুজুরকে দেখলাম যারা কোরবানি করেছে, বিসর্জন দিয়েছে তাদের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করা হচ্ছে, যাদের কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য হয়নি তাদের যেন ভবিষ্যতে কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য হয় সেই দোয়া ও করছে।
মসজিদ থেকে বাড়ি ফেরার পথে বিভিন্ন বাড়ি থেকে ভেসে আসছে রান্না করা গরুর মাংসের ঘ্রাণ। বাড়ি গিয়ে দেখলাম সবাই মাংস খাচ্ছে, আমরা যেহেতু কোরবানি করিনি তাই আমাদেরকে বিভিন্ন বাড়ি এবং সমাজ থেকে কিছু মাংস পাঠানো হয়েছে, সেই মাংস তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে আমার মা-বাবা এবং ছোট ভাই বোন গুলো! আমার হাতে পচা রক্তের গন্ধ, হৃদয়ে বীভৎস স্মৃতি। সেই বিরহের রাতে আমি মাংস খেতে পারিনি।
আমার বুঝে আসেনা পশু কোরবানিতে বিসর্জন হয় কার! মানুষের জীবনে অর্থ অনেক প্রিয়, সেই অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে ঘাম ঝরাতে হয়, তবুও প্রাণীর চেয়ে প্রিয় কোন দিন অর্থ হতে পারে না। যারে হৃদয়ে আঘাত লাগে, রক্তাক্ত অন্তর সৃষ্টি হয় বিসর্জন একমাত্র তাদের। অবলা বিসর্জনে কারোর বিসর্জন হয় বলে আমার মনে হয় না। বিসর্জন কর নিজেকে, নিজের হৃদয়ের কলুষতাকে, নিজের মূর্খতাকে, নিজের দুশ্চরিত্রকে।
মু.দিদারুল ইসলাম
বার্তা সম্পাদক, বার্তাজগৎ২৪ ডটকম
আপনার মতামত লিখুন :