পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসানের বিরুদ্ধে ‘বিতর্কিত নির্বাচন’, খুন, গুমে অংশ নেওয়াসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে দাবি করা হয়েছে, নাজমুল সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক থাকাকালে এসব কর্মকাণ্ড চালায়। ভুক্তভোগীদের বরাতে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, তার সময়ে সাতক্ষীরায় সবচেয়ে বেশি হত্যা, গুম ও গ্রেপ্তারের শিকার হন বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা।
সম্প্রতি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে থাকা এই কর্মকর্তার বিষয়ে তদন্তে নেমেছে গোয়েন্দা সংস্থা।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, নাজমুল আহসান জেলা প্রশাসক থাকাকালে ২০১৩-২০১৪ সালে সাতক্ষীরায় পুলিশের গুলিতে অর্ধশতাধিক জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিলেন। এসব কাণ্ডে তার ‘সহযোগী’ ছিলেন তৎকালীন পুলিশ সুপার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ সুপার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির বাংলাদেশ থেকে পালান। তবে বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন নাজমুল আহসান।
২০১৩ সালে ২৫ ডিসেম্বর সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগ দেন নাজমুল আহসান। ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি দায়িত্বে ছিলেন।
নাজমুল আহসান বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা। তিনি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) ছিলেন। ১১ ডিসেম্বর ২০২২ সাল থেকে তিনি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচে ২৫ এপ্রিল, ১৯৯৪ তারিখে যোগ দেন।
২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি শেখ হাসিনা সাতক্ষীরায় যৌথবাহিনীর ‘বিশেষ অভিযানের’ ঘোষণা দেন। সাতক্ষীরা সার্কিট হাউসে এক ঝটিকা সফরে এসে তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের এই বলে আশ্বস্ত করতে চাই, সাতক্ষীরায় সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ থাকবে না। সেজন্য যা যা করণীয় তা করা হবে। যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের কারণে দেশে যে সহিংসতা, মানুষ হত্যা, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে, তা কোনো অবস্থায় মেনে নেওয়া হবে না। বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা বাংলাদেশের যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের খুঁজে খুঁজে আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে।’
এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন ডিসি নাজমুল আহসান। তার সময়ে শুধু সাতক্ষীরা জেলাতেই ‘রাজনৈতিক সহিংসতায়’ ৪৩ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে যৌথবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন ২৭ জন। এদের সবাই স্থানীয় বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী।
এ ছাড়া আরো ২৫ জন নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক ব্যক্তি। তার নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাতক্ষীরার নাগরিকদের মধ্যে এখন চরম আতঙ্ক বিরাজ করে। রাত শুরু হলেই আতঙ্কে বিভিন্ন স্থানে চলে যেত নারীরাও। প্রতি রাতেই ঘটছে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটত। অগ্নিসংযোগ ও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হতো বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘর।
জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান যাদের সহযোগিতা নিয়ে এসব কাণ্ড চালাতেন তার মধ্যে তৎকালীন পুলিশ সুপার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির, সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম, সাতক্ষীরা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লাহ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনসুর আহমেদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মহসীন আলী, জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মীর মোদদছ্ছের আলী, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মশিউর রহমান মশু, প্রেস ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি ও জেলা আ.লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবু আহমেদ।
এ বিষয়ে জানতে নাজমুল আহসানকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি, এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি ফিরতি উত্তর দেননি।
‘ফ্যাসিবাদের নিয়ন্ত্রণে’ বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড: খোঁজ নিয়ে এবং কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর এখনো বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড-বাপাউবো এদের দোসরদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন)-এর বদলি ছাড়া গত ৬ মাসে কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগের মহাপরিচালক কিছু পদে পরিবর্তনের আশ্বাস দিয়েও, সেটা না করে তিনি পিআরএল-এ গেছেন বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমান নিশ্চিত করেন।
এ ছাড়া, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে শেখ হাসিনা সরকারের নিয়োগ করা সচিবদের বরখাস্ত করা হলেও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান বহাল তবিয়তে আছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আনসারদের ‘খেপিয়ে’ তোলার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি, বাপাউবোর ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদের’নেতারাও বহাল তবিয়তে কাজ করে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান বাপাউবোর ৩ জন প্রকৌশলী এবং একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক সরাসরি বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা। অন্যদিকে, ঢাকা পানি উন্নয়ন সার্কেল-১ ও ২ এ দুজন বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা এখনো কর্মরত। বাপাউবোর বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ সভাপতি এবং ভূমি পরিদপ্তরের পরিচালক বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম।
ঢাকা পানি উন্নয়ন সার্কেল-১ এর তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেওয়ান আইনুল হক বুয়েটে পড়ার সময় বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন বাংলাদেশে ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার সহ সভাপতি ছিলেন। তিনি সর্বশেষ ইউকসু নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ব্যানারে নির্বাচন করে পরাজিত হন বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী রাফিউস সাজ্জাদ।
গত বছরের ৭ অক্টোবর নাজমুল আহসানের দুর্নীতি, স্বজনপ্রতি ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধান চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। অভিযোগে বলা হয়, নাজমুল আহসান আওয়ামী লীগের সবচেয়ে সুবিধাভোগী আমলা। শেখ হাসিনার সরকারের সময় যে কয়জন আমলা বেশি সুবিধা ভোগ করেছে তার মধ্যে তিনি অন্যতম। শেখ হাসিনার আর্শীবাদপুষ্ট নাজমুল আহসান সাতক্ষীরা এবং খুলনা জেলার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :