ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪
জমির ঋণে জালিয়াতি

১৪৮ কোটি টাকা মেরে লাপাত্তা বাতেন ও মাহবুব

বার্তাজগৎ২৪ ডেস্ক

প্রকাশিত: আগস্ট ২৩, ২০২৪

১৪৮ কোটি টাকা মেরে লাপাত্তা বাতেন ও মাহবুব

রাজধানীর শান্তিনগরের ব্যবসায়ী আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান আহাদুজ্জামান বাতেন ও মাহবুব আলম একটি সার্ভে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশে ২০ কোটি ১৮ লাখ ২০ হাজার ৫০০ টাকা দামের জমিকে কাগজপত্রে ৮০ কোটি ৭২ লাখ ৮২ হাজার টাকা দেখান। এরপর ওই জমি বেসিক ব্যাংকের শান্তিনগর শাখার কাছে বন্ধক রেখে ২৫ কোটি টাকা ঋণ নেন।

ওই ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় বেড়ে ২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৪৮ কোটি ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩৯৪ টাকায় দাঁড়ায়। এ টাকা মেরে দিয়ে আত্মগোপন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক বাতেন ও মাহবুব। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে যে পরিমাণ জমি বন্ধক আছে, তা অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সরকারের বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর ও বেসিক ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

২০১৪ সালের আগস্ট মাসে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার অনুসন্ধানে নামে দুদক। অভিযোগ ছিল, ব্যাংকের ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করা হয়েছে। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ২ হাজার ২৬৫ কোটি আত্মসাতের তথ্য-প্রমাণ পাওয়ায় ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর ৫৬টি মামলা করে দুদক। মামলাগুলোতে মোট ১৫৬ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ২৬ জন বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং ১৩০ জন হচ্ছেন ৫৪টি ঋণগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ও সার্ভে প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মকর্তা। আসামিরা যাতে বিদেশ পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দুদক। ২০১৯ সালে আরও তিনটি মামলা করা হয়। সব মিলিয়ে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৫৯টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের বিরুদ্ধে করা মামলায় ৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। দুদক প্রায় সাত বছর মামলার তদন্ত করে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বিচারিক আদালতে ৫৯টি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে। অভিযোগপত্রে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ ১৪৮ জনকে আসামি করা হয়।

জানা গেছে, বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলে জড়িত অনেকে বিদেশে পালিয়ে যান। আবার অনেকে আত্মগোপন করেন। তখন থেকে আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান আহাদুজ্জামান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব আলম লাপাত্তা। তারা দেশে নাকি বিদেশে তার কোনো তথ্য নেই বেসিক ব্যাংকে ও দুদকে।

বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুর রহমানের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি। তবে ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় অর্থ আদালতে মামলা হয়েছে। মামলার রায়ের পর ভাসানটেক এলাকার বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে। এ সম্পত্তির কিছু অংশ বেদখল হয়ে গেছে, সেগুলো দখলমুক্ত করার চেষ্টা চলছে।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আলী ট্রেডের মালিকরা আত্মগোপনে আছেন। তারা দেশে না বিদেশে আমাদের জানা নেই। আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের অফিস বন্ধ। তাদের ঠিকানায় চিঠি পাঠালে তা ফেরত আসে। কিন্তু তাদের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।’

জানা গেছে, আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কাছে ২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ ১৪৮ কোটি ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩৯৪ টাকা। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অর্থ আদায়ে ২০২৩ সালে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। মামলায় আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান আহাদুজ্জামান বাতেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব আলম, জামিনদার আহসান হাবিব, তাছলিমা নাসরিন ও কামরুন নাহার বীথিকে আসামি করা হয়। আদালত বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম বিক্রির জন্য (অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩-এর ৩৩(১) ধারায়) দরপত্র আহ্বান করে। ২০২৩ সালের ১৭ মে দরপত্র দাখিলের শেষদিন নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ওইদিন পর্যন্ত সম্পত্তি নিলামে বিক্রি হয়নি।

বেসিক ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের যে সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রয়েছে, তার মূল্য ১৪৮ কোটি টাকা হবে না। তাই অর্থঋণ আদালত ৩৩(১) ধারায় দরপত্র আহ্বান করে নিলামে বিক্রি করতে পারেনি। পরে আদালত ৩৪(১) ধারায় দরপত্র আহ্বান করবে, তখনো বিক্রির  সম্ভাবনা কম। এরপর ৩৫(১) ধারায় সম্পত্তি ভোগদখলের দায়িত্ব ব্যাংককে দেওয়া হয়। তখন হয়তো ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেটি বিক্রি করতে পারবে। তবে ওই সম্পত্তি ১৪৮ কোটি টাকায় বিক্রি করা সম্ভব হবে না। ভাসানটেকের জমির দাম বেড়েছে, সে কারণে হয়তো ১০০ কোটি টাকা বিক্রি করা যেতে পারে।’

জানা গেছে, দুদকের মামলায় আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে ৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হলেও সরকারের বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের অডিটে ভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে। অডিট টিম ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে অডিটে দেখতে পায়, আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কাছে ব্যাংকের পাওনা ১২৫ কোটি ৪৬ লাখ ৯৩ হাজার ৬৯ টাকা। ব্যবস্থা নিতে অডিট প্রতিবেদনটি ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের জন্য পাঠানো হয়।

অডিট রিপোর্টে বলা হয়, ২০১২ সালের ১৩৪ দশমিক ৫৪৭ শতাংশ জমি বন্ধক রেখে আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ঋণ দিতে বেসিক ব্যাংকের শান্তিনগর শাখায় আবেদন করা হয়। আবেদেনের সঙ্গে এসডি সার্ভে ফার্মের একটি রিপোর্ট দাখিল করা হয়। ওই রিপোর্টে বন্ধকী জমির মূল্য দেখানো হয় ৮০ কোটি ৭২ লাখ ৮২ হাজার টাকা। ওই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংক থেকে ২৫ কোটি ৫০ লাখ ঋণ দেওয়া হয়। আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক, সার্ভে প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক কর্মকর্তা যোগসাজশ করে এ ঋণ মঞ্জুর করে। ঋণ নেওয়ার পর কোনো কিস্তি পরিশোধ করেনি আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। ফলে ঋণের সুদ বাড়তে থাকে। ঋণটি কয়েকবার পুনঃতফসিল করা হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৩১ জুলাই তিন মাসের গ্রেস পিরিয়ডসহ পাঁচ বছর মেয়াদে ঋণ পরিশোধের শর্তে ৭৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা পুনঃতফসিল করা হয়। শর্তের মধ্যে ছিল, ২০১৭ সালে ঋণের ৩৫ শতাংশ, ২০১৮ সালের মধ্যে ৫৫ শতাংশ এবং ২০২০ সালের মধ্যে ১০০ শতাংশ সহায়ক জামানত রাখতে হবে। আলী ট্রেড শর্ত পালনের অঙ্গীকার করেও পালন করেনি। ঋণগ্রহীতা ও জামিনদারের কাছ থেকে ফ্রেশ চার্জ ডকুমেন্ট সংগ্রহ করার কথা থাকলেও করেনি। মাঝেমধ্যে জমাকৃত অর্থকে ডাউন পেমেন্ট হিসেবে গণ্য করে ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়, যা বিআরপিডি সার্কুলারের লঙ্ঘন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ২০১৫ সালের ২ মার্চ গ্রাহকের বন্ধকী জামানত ই.এস ইন্সপেকশন অ্যান্ড কনসালটিং (বিডি) লিমিটেডের মাধ্যমে মূল্যায়ন করে দেখতে পায় বন্ধকী জমির মূল্য ২০ কোটি ১৮ লাখ ২০ হাজার ৫০০ এবং ডিসট্রেস মূল্য ১৬ কোটি ১৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪০০ টাকা। অথচ ২০১২ সালের সার্ভে রিপোর্টে জমিটির মূল্য দেখানো হয়েছে ৮০ কোটি ৭২ লাখ ৮২ হাজার টাকা। বন্ধকী জমির মূল্য বেশি দেখিয়ে আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ঋণ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ২০২১ সাল পর্যন্ত ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৫ কোটি ৪৬ লাখ ৯৩ হাজার ৬৯ টাকা। এ পরিমাণ অর্থের বিপরীতে জামানত আছে মাত্র ১৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। জামানত থেকে ঋণসীমা অনেক বেশি হওয়ায় ঋণের টাকা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের অর্থ আত্মসাতের ঘটনাটি জানার পর ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের রিকভারি শাখা থেকে ঋণ পুনঃতফশিল না করে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। কিন্তু শাখা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ ঋণ আদায় না করায় ব্যাংকের এ পরিমাণ অর্থ ক্ষতি হয়। যারা এ  অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, তাদের কাছ অর্থ আদায়সহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।

বার্তাজগৎ২৪

Link copied!