ঢাকা শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪
বিবিসি

শেখ হাসিনা: একদা গণতন্ত্রের আইকন যেভাবে একনায়ক

বার্তাজগৎ২৪ ডেস্ক

প্রকাশিত: আগস্ট ৬, ২০২৪

শেখ হাসিনা: একদা গণতন্ত্রের আইকন যেভাবে একনায়ক

দেশজুড়ে কয়েক সপ্তাহের ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলন-প্রতিরোধের মুখে গতকাল সোমবার পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। বিমানযোগে বাংলাদেশ ছাড়ার পরপরই উত্তেজিত জনতা তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ঢুকে পড়ে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ওপর শেখ হাসিনা দেড় দশকেরও বেশি সময়ের শাসন অপ্রত্যাশিতভাবে শেষ হয়। 

শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে টানা ২০২৪ সালের আগস্টের পাঁচ তারিখ পর্যন্ত দেশ শাসন করেছেন। তবে সব মিলিয়ে তিনি ২০ বছরের বেশি সময় বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় ছিলেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের অবদান অনেকটাই শেখ হাসিনার।

আওয়ামী লীগের এই নেত্রী রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের পক্ষের নেত্রী হিসেবে। অথচ, ইতিহাসের নির্মম পরিক্রমায় সেই ‘স্বৈরাচার’ তকমা নিয়েই তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই তার বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী শাসনের অভিযোগ উঠেছে। তিনি তার রেজিমের বিরোধীদের কঠোরভাবে দমন করেছেন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেপ্তার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ক্ষমতার অন্যান্য অপব্যবহার সবই তার শাসনামলে বৃদ্ধি পেয়েছে। 

শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় জন্মগ্রহণ করেন। রাজনীতি শেখ হাসিনার রক্তে মিশে আছে। তাঁর বাবা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’। যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং দেশে প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সে সময় শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেত্রী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন।

বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের আগস্টের ১৫ তারিখে এক সেনা অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যকে হত্যা করা হয়। শুধু হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা বেঁচে ছিলেন। কারণ তারা তখন তারা ইউরোপের একটি দেশে ছিলেন। এর পর সেখান থেকে তারা ভারতে ফেরেন। নির্বাসিত জীবন শেষে হাসিনা ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফেরেন এবং তার বাবার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা হন।

এরপর একনায়ক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনের সময় গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের অংশ হিসেবে তিনি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেন। যে আন্দোলন শিগগির অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর হাসিনা দ্রুতই জাতীয় আইকনে পরিণত হন।

তবে স্বৈরশাসনের অবসানের পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে তিনি ক্ষমতায় আসতে পারেননি। আসেন আরও পাঁচ বছর পর, ১৯৯৬ সালে। তার প্রথম মেয়াদে তিনি ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন চুক্তি ও পার্বত্য শান্তি চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। তবে একই সময়ে, তার সরকারের বিরুদ্ধে বহু দুর্নীতিমূলক ব্যবসায়িক চুক্তি ও ভারতের খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।

এরপর ২০০১ সালে শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়ার দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কাছে হেরে যান। পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির অভিযোগ থাকলেও এই দুই নারীই তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিলেন এবং তারা ‘ব্যাটলিং বেগমস’ পরিচিত ছিলেন। সাধারণত, বেগম বলতে উচ্চপদস্থ মুসলিম নারীদের বোঝানো হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই দুই বেগমের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে বাসে বোমা, গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এরপর ২০০৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হাসিনা আবারও ক্ষমতায় ফেরেন।

শেখ হাসিনাকে অনেকে ‘পলিটিক্যাল সারভাইভার’ বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। তিনি বিরোধী দলে থাকাকালে একাধিকবার গ্রেপ্তার, বেশ কয়েকটি গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন। যার মধ্যে ২০০৪ সালের আগস্টে তার বিরুদ্ধে গ্রেনেড হামলার ঘটনা অন্যতম। এই হামলা তার শ্রবণশক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। তাকে জোরপূর্বক নির্বাসনে পাঠানোর প্রচেষ্টাও করা হয়েছিল। আদালতের দায়ের করা হয়েছিল বেশ কয়েকটি দুর্নীতি মামলা।

২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি বিপরীত চিত্র উপস্থাপন করে। একসময় বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্রতম দেশ হিসেবে পরিচিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে।

এটি এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। এমনকি তার আমলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার প্রতিবেশী ভারতকেও ছাড়িয়ে যায়। গত দশকে দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় তিনগুণ বেড়েছে এবং বিশ্ব ব্যাংকের অনুমান, গত ২০ বছরে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের এই প্রবৃদ্ধির বেশির ভাগই গার্মেন্টস শিল্পের অবদান। এ ছাড়া, নিজস্ব তহবিল, ঋণ ও উন্নয়ন সহায়তা ব্যবহার করে হাসিনা সরকার পদ্মা নদীর ওপর ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতুসহ আরও বিশাল বিশাল অবকাঠামো প্রকল্পও গ্রহণ করেছে।

সর্বশেষ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে তা দ্বিতীয় মেয়াদে তার ক্ষমতা গ্রহণের পর সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে মাস সাতেক আগেই তিনি একটি অত্যন্ত বিতর্কিত নির্বাচনের আয়োজন করেন। যেখানে তার দল টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করে।

মূলত সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে, পুলিশ ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের সহিংসভাবে দমন করেছেন তিনি কিন্তু একটি ব্যাপক সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল কারণ তিনি। যার ফলে, এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ শ জন নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছেন আরও অন্তত কয়েক শ।

পদত্যাগের ঠিক আগে শেখ হাসিনা বেশ বিদ্বেষমূলক কথা বলেছেন। তিনি আন্দোলনকারীদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে নিন্দা করেন এবং ‘দৃঢ় হাতে এই সন্ত্রাসীদের দমন’ করার জন্য দেশবাসীর কাছে সমর্থনের আবেদন করেছিলেন। তিনি শতাধিক লোককে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন এবং আরও শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ এনেছেন।

কোভিড মহামারি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়সহ অন্যান্য কারণেই কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। এ ছাড়া, আকাশচুম্বী মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস এবং ২০১৬ সালের পর দেশের বৈদেশিক ঋণ দ্বিগুণ হওয়ার বিষয়টি তার সরকারের বিরুদ্ধে গেছে।

সমালোচকেরা এর জন্য হাসিনার সরকারের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন। তারা বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য ব্যাপক দুর্নীতির কারণে কেবল হাসিনার আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠদের লাভবান করেছে। তাদের অভিযোগ, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিনিময়ে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে।

হাসিনার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সমালোচক ও গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে দমনমূলক কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপ নেওয়ার অভিযোগ আছে। এ সময়ে যে নেত্রী গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন, তার জন্য এই পরিবর্তন একটি বিশাল বিষয়। অধিকার গোষ্ঠীগুলোর অনুমান, ২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে অন্তত ৬০০ গুমের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে আরও শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও আছে।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বিরুদ্ধেও ক্ষমতার গুরুতর অপব্যবহার ও নির্যাতনের অভিযোগ আছে। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তাদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। শেখ হাসিনার আমলে অনেক মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক গ্রেপ্তার, নজরদারি ও হয়রানিসহ ক্রমবর্ধমান আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছেন। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন ব্যবহার করা হয়েছে। সমালোচকদের মতে এই আইন সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করেছে।

হাসিনা ও তার সরকার অর্থনীতিবিদ ও নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে মামলা দিয়ে ‘বিচারিক হয়রানি’ করার জন্যও অভিযুক্ত। চলতি বছরের শুরুতে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল এবং তাঁর বিরুদ্ধে শতাধিক অভিযোগ এনেছিল হাসিনা সরকার।

এ ছাড়া, চলতি বছরের নির্বাচনের আগে তার সরকারবিরোধী দলের বিক্ষোভের পর হাজার হাজার সমর্থকসহ বিএনপির অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছিল। অধিকার গোষ্ঠীগুলো বক্তব্য, বিরোধীদের শক্তিহীন করার লক্ষ্যেই এ ধরনে প্রচেষ্টা চালিয়েছে হাসিনা সরকার। তবে হাসিনার সরকার ক্ষমতার এ ধরনের অপব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে এই অভিযোগগুলো তদন্ত করতে চাওয়া বিদেশি সাংবাদিকদের বাংলাদেশ সফরকে কঠোরভাবে সীমিত করেছে।

বার্তাজগৎ২৪

Link copied!