দেনাগ্রস্ত কোম্পানি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেড। দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় রাষ্ট্রীয় এই সংস্থার বড় কর্তাদের হরহামেশাই বিব্রত হতে হয়। কখনো জ্বালানি সরবরাহ বন্ধের ঘোষণা দেয় বাণিজ্যিক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। কখনোবা তদারকি সংস্থা সিভিল এভিয়েশন অথরিটি (সিএএবি) তাগাদা দেয় বকেয়া পরিশোধের। আবার কখনো কখনো চোখ রাঙায় বিধিবদ্ধ সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই ত্রাহি অবস্থার মধ্যেও বিমানকর্মীরা এই মাসে প্রফিট বোনাস (লাভের ভাগ) নিয়েছেন। তার আগে সরকারি কোম্পানি হিসেবে যথানিয়মে ঈদ ও বৈশাখী বোনাসও পেয়েছেন।
অথচ বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্র্তৃপক্ষের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন চার্জ ও ফি বাবদ বিমানের কাছে তাদের বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল বকেয়া ৯৫৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা হলেও ভ্যাট, আয়কর ও নিয়মিত বকেয়া পরিশোধ না করায় সারচার্জ মিলে দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে জেট ফুয়েলের (বিমানের জ্বালানি) দামও নিয়মিত পরিশোধ না করায় বিমানের কাছে বিপিসির পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া আছে উড়োজাহাজ কেনার বিপুল দেনা। ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বোয়িং থেকে কেনা উড়োজাহাজগুলোর পাওনা অর্ধেকের বেশি শোধ হয়েছে।
২০২২ সালের অক্টোবরে সিএএবির বকেয়া আয়ের ওপর নজর দেয় দুদক। ওই সময় বিমানের কাছে সিএএবির পাওনা ছিল ৩ হাজার ৯২ কোটি টাকার বেশি। দুদক সিএএবির এই বিরাট অঙ্কের টাকা বকেয়া পড়ার কারণ জানতে চায় প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাছে। একই সঙ্গে তারা বিপুল পরিমাণ টাকা বকেয়া পড়ায় কার বা কাদের গাফিলতি তা খুঁজে বের করার তাগিদ দেয়। প্রথম চিঠির ১৯ মাস পর দুদক থেকে দ্বিতীয় চিঠি দেওয়া হয়। যেখানে বকেয়ার কারণ এবং বকেয়া আদায়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা ১৫ দিনের মধ্যে জানাতে বলা হয়। যদিও মন্ত্রণালয় থেকে দায়সারা একটি জবাব দেওয়া হয়।
গত ২৮ ডিসেম্বর বিমানের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) হয়। এজিএমে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৩ কোটি টাকা নিট মুনাফার ঘোষণা আসে। গত অর্থবছরে সংস্থাটি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটে ৩১ লাখ যাত্রী পরিবহন করেছে। আগের অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ২২ লাখ। সেই হিসাবে ৯ লাখ যাত্রী অতিরিক্ত পরিবহন করলেও এর প্রতিফলন নেই বিমানের নিট মুনাফায়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিমানের মুনাফার মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। বিপুল দেনা রেখে নিট মুনাফা ঘোষণা করে কীভাবে, তা জানার জন্য বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শফিউল আজিমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। এমডির মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠানো হয়, বিমানের জনসংযোগ শাখায় যোগাযোগ করা হয়। এমনকি সিইও সেক্রেটারিয়েটের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে জানানো হয় দেশ রূপান্তরের একজন সাংবাদিক এমডির সঙ্গে কথা বলতে চান প্রতিবেদন তৈরির বিষয়ে। তারপরও সাড়া মেলেনি।
এমডির বক্তব্য না পেয়ে বিমানের অপর একজন কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, নির্দিষ্ট বছরের লাভ-লোকসান ওই বছরে কোম্পানির সব পরিচালনা (অপারেশনাল) ও অপরিচালন (নন-অপারেশনাল) আয়-ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করে নির্ণয় করা হয়। ফলে শ্রম আইন অনুযায়ী নির্ণীত লাভ থেকে ৫ শতাংশ শ্রমিকের অংশগ্রহণ ও কল্যাণ তহবিলে দেওয়ার ক্ষেত্রে পুঞ্জীভূত দেনার হিসাব টেনে আনার কোনো সুযোগ নেই। শ্রম আইন অনুযায়ী, নিট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকের অংশগ্রহণ তহবিল এবং কল্যাণ তহবিলে ওই ৫ শতাংশের ৮০:২০ অনুপাতে প্রদান করতে হবে। শ্রমিকের অংশগ্রহণ তহবিলে স্থানান্তরিত অংশের, অর্থাৎ ৮০-এর দুই-তৃতীয়াংশ নির্দিষ্ট অনুপাতে শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন করার বাধ্যবাদকতা রয়েছে।
ওই কর্মকর্তা মুনাফা বণ্টনের বাধ্যবাধকতা তুলে ধরলেও বিমানের দায়দেনা পরিশোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানাতে পারেননি।
বিমানকর্মীরা জানিয়েছেন, গত মঙ্গলবার তাদের ব্যাংক হিসাবে মার্চ মাসের বেতনের সঙ্গে ঈদ বোনাস, বৈশাখী বোনাস ও প্রফিট বোনাস ঢুকেছে। বিমানের প্রায় আট হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব বোনাস ও বেতনের টাকা পেয়েছেন। তবে ৮৯ দিনের ক্যাজুয়াল (অস্থায়ী) কর্মীরা প্রফিট বোনাস পাননি।
দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সরকারের যত কোম্পানি আছে, সেগুলো সব করদাতাদের টাকায় পরিচালিত হয়। সেখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন দরকার। সেখানে অভাব দেখানো হয়। সেখানে অপারেটিং প্রফিট (পরিচালন মুনাফা) থেকে সুযোগ-সুবিধা বণ্টন করা হয়। কিন্তু হিসাবটা করতে হবে দায়দেনা সবটা মিলিয়ে। হিসাবের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে করা হয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসনের অভাব রয়েছে। এটি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতিতে পড়ার মূল কারণ। কিন্তু বাইরে আমরা দেখি, সরকার কৌশলগত কারণে বিমানসহ অনেক কিছু চালায়। যারা ভালো করছেন, তারা ম্যানেজমেন্ট (ব্যবস্থাপনা) থেকে শুরু করে সবকিছু প্রফেশনালি (পেশাদার) করায়। তারা বেসরকারি খাতের মতোই কাজ করে।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘দ্বিতীয় আরেকটি দিক হলো বিমানের ন্যূনতম একটি বহর রাখতে হয়। অনেক সময় সঠিক বিনিয়োগ করা হয় না। ভালোভাবে কার্যক্রম চালাতে গেলে যেটি করা দরকার, সেটি করা হয় না। এগুলোর ব্যবস্থাপনা করতে হবে পেশাগত দিক থেকে চিন্তা করে। এখানে সুশাসনই গুরুত্বপূর্ণ দিক।’
বিমানের দায়দেনার বিষয়ে হরদমই বৈঠক হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে। কখনো কখনো মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও বৈঠক ডাকছে। এ প্রসঙ্গে সিএএবির একজন কর্মকর্তা বলেন, বিমান কর্মকর্তারা এখন বৈঠকেও অংশ নিতে চান না। একই ধরনের কথা বলেছেন বিপিসির কর্মকর্তারাও।
বিমানকে করপোরেশন থেকে কোম্পানি করা হয়েছে চারটি শর্তে। প্রথম শর্তই ছিল জনবল ৩ হাজার ৪০০তে নামিয়ে আনা। কিন্তু বিমান তা করেনি; বরং জনবল বাড়িয়েছে। সংস্থাটি সুবিধামতো জনবল বাড়াতে গিয়ে এখন পর্যন্ত সাংগঠনিক কাঠামো চূড়ান্ত করেনি। সম্প্রতি জনবলকাঠামো মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তা পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদন করার কথা বলেছে মন্ত্রণালয়। বিমানের যেসব খাতে অনিয়ম হয় এর মধ্যে জনবল নিয়োগ অন্যতম। জনবল নিয়োগে অনিয়মের জন্য বর্তমানে আদালতে মামলাও চলছে।
অন্যান্য শর্তের মধ্যে জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণ এবং আমদানি ও সরবরাহের বিষয়টি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত ছিল।
বিমান নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়েও অসন্তোষ রয়েছে। কিন্তু ন্যাশনাল ক্যারিয়ারের তকমা নিয়ে বিমান সংশ্লিষ্টদের সহানুভূতি আদায় করছে। ২০১৮ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ বিমানে আমরা অনবরত টাকা দিয়ে যাচ্ছি। তাদের বর্তমান ফ্লিটে মোটামুটি নতুন বিমানই আছে। তাদের জনবল অন্য বিমান সংস্থার তুলনায় বেশি। তাদের আমরা অনবরত ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছি। এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। আমার মনে হয় বিমান মোটেই বাণিজ্যিক বিবেচনা করে চলে না।’
আপনার মতামত লিখুন :