ঢাকা রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

পিডির পকেট ভরতে কাজ কেটে খানখান

বার্তাজগৎ২৪ ডেস্ক

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২৪

পিডির পকেট ভরতে কাজ কেটে খানখান

রাজধানীতে ১৫৫ কোটি ৭৬ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের () প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। দুটি বেসমেন্টসহ ১০ তলা ভবনের নির্মাণকাজ চলা অবস্থায় ওই প্রকল্প থেকে টাকা নিয়ে অন্য একটি ভবনে নিজেদের ইচ্ছেমাফিক খরচ করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক (পিডি) প্রায় ৫৪ কোটি টাকার একক কাজ ২৬ খণ্ডে ভাগ করেছেন। একক কাজ ছোট ছোট প্যাকেজে ভাগ করে দরপত্র অনুমোদনসহ সব প্রক্রিয়াই সেরেছেন পিডি নিজে।

জানা গেছে, বিআইএমের পরিচালক তানভীর হোসাইন ওই প্রকল্পের পিডি। এক প্রকল্প থেকে টাকা সরিয়ে অন্য জায়গায় কাজে লাগানো এবং একক কাজ ভেঙে ২৬টি প্যাকেজে ভাগ করার ক্ষেত্রে তিনি পদে পদে সরকারি ক্রয় বিধিমালা (পিপিআর) লঙ্ঘন করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ কোনো অসুবিধা না থাকলে একক কাজ ভাঙার সুযোগ নেই। একক কাজ খণ্ড খণ্ড করা হয় মূলত নিজের বলয়ের মধ্যে অনুমোদনপ্রক্রিয়া শেষ করতে।

এ বিষয়ে পিডি তানভীর হোসাইনের সঙ্গে কথা বলতে গত রবি ও সোমবার তাঁর দপ্তরে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে বিস্তারিত জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠিয়ে দুদিনে কমপক্ষে ১০ বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

পিডির দপ্তরের পাশে থাকা উপপ্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) লামিয়া ফারহা অবশ্য বলেন, ‘আমি দুই-তিন মাস হলো এ দায়িত্বে এসেছি। এসব কাজ আগেই শেষ হয়েছে। এখন শেষ মুহূর্তে শুধু বুঝে নেওয়ার পালা। তাই আমি খুব বেশি গভীরের তথ্য জানি না। পিডি স্যার মিটিংয়ে বাইরে থাকতে পারেন। তবে এতটুকু বলতে পারি, সব মিলিয়ে আমরা ১৭টি সিভিল ও ২টি ইলেকট্রো মেকানিক্যাল (ইএম) কাজ করেছি। এখানে সব আইন মেনেই করা হয়েছে।’

একক কাজ একাধিক প্যাকেজে বিভক্তকরণ বিষয়ে পিপিআরে বলা আছে, ক্রয় পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় কোনো নির্দিষ্ট ক্রয়পদ্ধতি বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা পরিহারের উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প বা কর্মসূচির কোনো অংশ নিম্নতর মূল্যমানের একাধিক প্যাকেজে বিভক্ত করা যাবে না। একক ক্রয়কাজ একাধিক প্যাকেজে বা লটে বিভক্ত করা হলেও এর কোনো একটি প্যাকেজ বা লটের জন্য চুক্তি সম্পাদনের নোটিশ দেওয়ার আগে প্যাকেজ বা লটগুলোর মোট মূল্য যে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের এখতিয়ারভুক্ত, সেই কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্যাকেজ বা লটের দরপত্র অনুমোদনের জন্য পেশ করতে হবে।

নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিআইএমের নতুন বহুতল ভবনের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভবন নির্মাণ (সিভিল) ৭৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং ইএম অংশে আরও ২৭ কোটি টাকা। বাকি প্রায় ৫৪ কোটি টাকার পুরোটাই নানা ধরনের কেনাকাটা ও মেরামতের নাম দিয়ে ব্যয় দেখানো হয়েছে। প্রকল্প থেকে অর্থ নিয়ে পুরোনো একটি ভবনেও টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।

৫৪ কোটি টাকার কাজ ২৬ খণ্ডে ভাগ করে পিডি নিজেই ক্রয় দরপত্র আহ্বান, অনুমোদন ও বিল দেওয়ার কাজ শেষ করেছেন। ২৬টি কাজের মধ্যে আছে ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন ও ব্লেন্ডার ক্রয় ২৫ লাখ টাকা; ফটোকপি মেশিন পাওয়ার ট্রিপ, ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা; ডিহিউমিডিফায়ার, ওয়াটার হিটার ও বৈদ্যুতিক রক্ষণাবেক্ষণের সরঞ্জাম ইনস্টলেশন ১০ লাখ; বেসমেন্ট, গ্রাউন্ড ফ্লোর, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার আসবাবপত্র ২ কোটি ৩৮ লাখ ৮ হাজার টাকা; চতুর্থ ও পঞ্চম তলার আসবাবপত্র ৬ কোটি ৭৪ লাখ ২৭ হাজার; ষষ্ঠ থেকে দশম তলার আসবাবপত্র ৫ কোটি ৩৩ লাখ ১৮ হাজার টাকা; পিডির দপ্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার, ইউপিএস ৫ লাখ টাকা; সিসি ক্যামেরা বসানো ২ লাখ ৬১ হাজার টাকা; পিডির দপ্তরে স্মার্ট বোর্ড ও মাল্টিমিডিয়া ৪ লাখ ৯৭ হাজার টাকা; মাইক্রোবাস ও জিপ ১ কোটি টাকা; পিডির কক্ষে এসি ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা; পাঁচটি লিফট ৪ কোটি ২৮ লাখ ৬৬ হাজার টাকা; পিডির দপ্তরে কম্পিউটার ও ল্যাপটপের জন্য সফটওয়্যার ৫ লাখ টাকা; ৩০০ কম্পিউটার কেনা ৩ কোটি টাকা; ৩০ এইচটি সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প মোটর সেট ৬৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকা; সোলার প্যানেল সিস্টেম ৩৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা; ফোর্স ভেন্টিলেশন সিস্টেম ১ কোটি টাকা; সাইনবোর্ড, টেলিফোন, কনফারেন্স হল, ডিজিটাল কার পার্কিং ও এক্সেস কন্ট্রোল সিস্টেম ২ কোটি ৯৬ লাখ ৯২ হাজার টাকা; এয়ার কন্ডিশন সিস্টেম ৭ কোটি ২ লাখ ২৩ হাজার টাকা; ওয়্যারলেস ও কম্পিউটার ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা; সিসিটিভি সিস্টেম ৬৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা; অডিটরিয়ামের স্টেজ লাইট ও সাউন্ড সিস্টেম ১ কোটি টাকা; মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ভিডিও কনফারেন্স সিস্টেম ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা; ফায়ার প্রটেকশন ও অ্যালার্ম সিস্টেম ৪ কোটি ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা; প্রশাসনিক ভবনে কয়েকজন কর্মকর্তার রুম মেরামত বাবদ ৯০ লাখ টাকা; প্রশাসনিক ভবনে একতলায় থাই গ্লাস ৯ লাখ ৮৩ হাজার টাকা; প্রকল্প অফিসে থাই গ্লাস ৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা; মহাপরিচালকের কক্ষে টাইলস বসানো ৯ লাখ ৮৮ হাজার টাকা; প্রশাসনিক ভবনে দ্বিতীয় তলায় ওয়েটিং রুম মেরামত ৯ লাখ ৮৬ হাজার; প্রকল্প অফিসে কাঠের দরজা ও স্যানিটারি-সামগ্রী ৯ লাখ ৯৮ হাজার; প্রকল্প অফিসে টাইলস ও সিভিল কাজ ৯ লাখ ৯৮ হাজার; সাততলায় করিডরে টাইলস ৯ লাখ ৯২ হাজার; হোস্টেল ভবনের আসবাবপত্র ও ইলেকট্রিক সামগ্রী হস্তান্তর ও সংরক্ষণ ৯ লাখ ৯১ হাজার টাকা; প্রধান গেট, সাব গেট, সামনের সীমানাপ্রাচীর ১ কোটি ৬৫ লাখ; ভবনসংলগ্ন রাস্তা উঁচুকরণ ১ কোটি ৬৫ লাখ এবং নতুন ভবনের ইন্টেরিয়র ডিজাইন, কনফারেন্স রুম, অভ্যর্থনা কক্ষ, মিটিং রুমের নামে ৩ কোটি ৩৫ লাখ ৫৪ হাজার টাকা।

স্থপতি ইকবাল হাবিবের মতে, একক কাজ এভাবে খণ্ড করা হয় মূলত নিজের বলয়ের মধ্যে অনুমোদনপ্রক্রিয়া শেষ করতে। এতে সবকিছু পিডির কবজায় রেখে নিজের পছন্দমতো ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে অনৈতিক সুবিধা নিতে সুবিধা হয়। এর ফলে কাজের গুণগত মান আর থাকে না। সেই সঙ্গে ভুয়া বিল-ভাউচারে সরকারি অর্থ ব্যক্তির পকেটে চলে যায়।

প্রকিউরমেন্ট বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী এস এম ফজলুল কবির বলেন, বিশেষ কোনো অসুবিধা না থাকলে একক কাজ ভাঙার সুযোগ নেই। এরপরও যদি একাধিক প্যাকেজ করা হয়, তাহলে আর্থিক এখতিয়ার অনুযায়ী মোট মূল্যের জন্য যে পর্যায়ের অনুমোদন নিতে হতো, সেখান থেকেই নিতে হবে। এখানে পিডির এসব ক্রয় অনুমোদন করার ক্ষমতা নেই।

বার্তাজগৎ২৪

Link copied!