যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ঝাঁ-চকচকে কক্ষে মন্ত্রীর চেয়ারটা আগের মতোই আছে। তবে বদলে গেছে চেয়ারের মানুষ আর কক্ষের বাইরে নামফলক। নাজমুল হাসান পাপনের জায়গায় এখন ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন ২৬ বছরের তরুণ আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। শুধু মন্ত্রণালয় নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতির পদও হারাতে যাচ্ছেন পাপন, যে পদ তিনি ১২ বছর ধরে আঁকড়ে ধরে ছিলেন।
২০১২ সালের অক্টোবরে বিসিবি সভাপতির চেয়ারে বসেন পাপন। সেই যে বসেছেন, আর ছাড়েননি। টানা ১২ বছর সভাপতি থাকায় ক্রিকেট বোর্ডের প্রায় সবখানেই নিজের পছন্দের লোক বসিয়েছেন তিনি। সরকারপ্রধানের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় চাইলেই ক্রিকেটের উন্নয়নে যেকোনো কিছু দ্রুত করে ফেলার ক্ষমতা ছিল তাঁর। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। বিসিবি প্রধানের চেয়ারে বসে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাময় ক্রিকেটকে ধ্বংসের ‘গুরুতর অভিযোগ’ উঠেছে পাপনের বিরুদ্ধে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে এখন একে একে প্রকাশ্যে আসছে পাপন এবং তাঁর লোকজনের যত পাপ।
পাপনের এক যুগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অর্জন বেশ ম্লান হলেও অর্থকড়িতে বেশ ধনী হয়েছে বিসিবি। এফডিআর থেকে বিসিবির আয় প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। আর বর্তমানে বোর্ডের পুঞ্জীভূত তহবিলই ছাড়িয়ে গেছে হাজার কোটি টাকা। বিসিবির বিপুল এই টাকার পাহাড় গড়তে পাপনের নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পরিষদকে তেমন কোনো ‘ম্যাজিক’ দেখাতে হয়নি। তারা শুধু ‘কইয়ের তেলে কই ভেজেছে’! বিসিবির আয়ের বড় উৎস আইসিসি-এসিসির লভ্যাংশ ভাগাভাগি। কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই বিপুল অঙ্কের টাকায় কোষাগার ফুলে-ফেঁপে ওঠার পরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে (বিশেষ করে পুরুষ) বাংলাদেশ দলের বড় কোনো সাফল্য নেই। মাঝেমধ্যে কিউরেটর গামিনি ডি সিলভার মাধ্যমে মিরপুরের উইকেটকে ব্যাটারদের ‘বধ্যভূমি’তে পরিণত করে শক্তিশালী কয়েকটি দলের বিপক্ষে জয়কে নিজেদের ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করেছে তারা।
পাপন ও তার সঙ্গীরা ক্রিকেটের উন্নয়নে কার্যকর কী করেছেন, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলবে গত এক দশকে বিসিবির বাজেটগুলো দেখলেই। এসব বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিসিবির বেশি খরচ ছিল লজিস্টিকস অ্যান্ড প্রটোকল, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) আর ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফল যা-ই হোক, ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের অধীনে বিদেশি ‘হাই প্রোফাইল’ কোচ নিয়োগে বিশেষ মনোযোগ ছিল পাপনের। বিদেশি কোচ নিয়োগে কিছু পরিচালকের ‘কমিশন-বাণিজ্য’ ক্রিকেটপাড়ায় ওপেন সিক্রেট। বছরের পর বছর বিসিবির অর্থ বিভাগ, লজিস্টিকস আর বিপিএল দেখার দায়িত্বে থেকেছেন পাপনের আশীর্বাদপুষ্ট ইসমাইল হায়দার মল্লিক; যিনি নিজেকে এই ১২ বছরে সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন ক্রিকেট বোর্ডে। দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট ধ্বংসের পেছনেও এই মল্লিকের নাম এসেছে বারবার। প্রচারপ্রিয় পাপন তাকে তো থামানইনি, উল্টো ‘লাইসেন্স’ দিয়েছেন আরও প্রতাপশালী হতে।
নিজেদের রাজত্ব ঠিক রাখতে অনেক সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি করতে পাপনরা এমন জায়গায় অর্থ ঢেলেছেন, যেটির সঙ্গে ক্রিকেটের কোনো সংযোগ নেই। ২০২০ সালে মুজিব বর্ষ উদ্যাপনে বিশাল আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল বিসিবির। করোনা মহামারির কারণে সে পরিকল্পনা থেকে তাদের সরে আসতে হয়। এরপরও ‘ক্রিকেট সেলিব্রেটস মুজিব ১০০’ নামে বিসিবি খরচ করেছে ২০ কোটি টাকা। ভারতের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী এ আর রাহমানকে এনে কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে, যেটির সঙ্গে ক্রিকেটের কী সম্পর্ক, তা অজানা। ২০১৯ সালে ‘বঙ্গবন্ধু বিপিএল’ নামে ৮০ কোটি টাকা খরচ করেছে বিসিবি। নিয়মিত ঘরোয়া ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ বাদ দিয়ে নিজেদের খরচে এমন টুর্নামেন্ট আয়োজনের উদাহরণ বিশ্বের কোথাও নেই।
বেশির ভাগ ক্রিকেট বোর্ড নিজেদের আয়-ব্যয়ের পূর্ণ বিবরণ তুলে দেয় তাদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে। এখানেও বিসিবির যত লুকোছাপা। বছরের পর বছর একই অডিট প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা, আইনিপ্রক্রিয়ায় পাওনা টাকা আদায়ের উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো বিপুল অঙ্কের টাকা ছেড়ে দেওয়া, ক্রয়াদেশে স্বচ্ছতার অভাব, দরপত্রপ্রক্রিয়ার বাইরে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার অভিযোগ তো আছেই। বোর্ডের স্বার্থের সংঘাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন পাপন। পাপনের বোর্ডে স্বার্থের সংঘাত ছিল প্রায় প্রতিটি জায়গায়। বোর্ড থেকে শুরু করে ক্লাব ক্রিকেট—সব জায়গায় নিজেদের দাপট ধরে রাখা আর ক্ষমতার চেয়ার নিজেদের দখলে রাখতে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে ঘরোয়া ক্রিকেট। ঠিক একই কারণে ক্রিকেট মিরপুর থেকে সারা দেশে ছড়ায়নি। হয়েছে ‘আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা’র নামে শুধুই অর্থের অপচয়।
পাপনের মেয়াদে সবচেয়ে বড় প্রকল্প ছিল পূর্বাচল স্টেডিয়াম। হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মাণ করতে যাওয়া এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বাস্তবায়ন করার আগেই বিসিবি পরামর্শক ফি দিয়েছে ৭৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রেখেছিল ২৫০ কোটি টাকা। অথচ শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামটা ‘পরিত্যক্ত’ থেকেছে বছরের পর বছর।
বোর্ডের কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা কিংবা ভিন্নমতকে একদম জায়গা দেননি পাপন। বিসিবির কঠোর সমালোচনা করায় আইসিসিতে কর্মরত সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলকেই একাধিকবার হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। যেসব সংগঠক শতভাগ আনুগত্য স্বীকার করেননি, তারা যেন বোর্ডে আসতে না পারেন—সব ব্যবস্থাই করেছে পাপনের বোর্ড। লম্বা সময় ধরে বেশির ভাগ স্ট্যান্ডিং কমিটি সংগঠকশূন্য রেখে ম্যানেজারদের দিয়েই ক্রিকেট প্রশাসন চালানো হয়েছে।
যে ক্রিকেটারদের ব্যবহার করে পাপনদের এত দাপট, অনেক সময় খেলোয়াড়দের প্রাপ্য সম্মানও দেওয়া হয়নি। বছরের পর বছর প্রশ্ন থেকেছে দল নির্বাচন নিয়ে। সাকিব আল হাসানের মতো খেলোয়াড়, যখন যা ইচ্ছে করলেও বিসিবি শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি নৈতিকতার জায়গায় নিজেদের দুর্বল অবস্থানের কারণে। ভোট নিশ্চিত রাখতে পছন্দের কাউন্সিলরদের কাউন্সিলরশিপ দিয়ে অনেকটা সাজানো নির্বাচনে বারবার জয়ী হয়ে আসা পাপনের অধীনে বিসিবির যত বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) হয়েছে, সেগুলো দেশের ক্রিকেটে শুধুই সদস্যদের দামি উপহার প্রাপ্তির অনুষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
ক্রিকেট বিশ্লেষক নাজমুল আবেদীন ফাহিম বললেন, ‘সততা, স্বচ্ছতা, নৈতিকতার অভাব ছিল। এ সময়ে অনেক দেশই ক্রিকেটে ভালো করেছে, তাদের এত বড় তহবিল নেই। তবে তাদের স্বচ্ছতা, নৈতিকতা ছিল। আমাদের বোর্ডের লক্ষ্য একটাই ছিল যে কীভাবে পরের নির্বাচনটা জেতা যায়, তার পরের নির্বাচনটা কীভাবে জেতা যায়। সেই লক্ষ্যপূরণে যে ম্যানিপুলেশনের দরকার হয়, সেটি করে ঢাকার ক্রিকেট নষ্ট করে দিয়েছে। ফল কী হয়েছে? আমাদের ক্রিকেটারদের চরিত্র নষ্ট হয়েছে। আয়োজক, আম্পায়ারদের চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। কোচ বা এ-সংক্রান্ত সবারই চরিত্র নষ্ট হয়েছে। এমনকি গণমাধ্যমেরও! সবকিছুরই। এটা বড় অপরাধ।’
বিসিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এসিসির সাবেক প্রধান নির্বাহী সৈয়দ আশরাফুল হক মনে করেন, গত ১২ বছরে বিসিবিতে যারা অনিয়ম আর দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলেন, সবাইকে শাস্তির আওতায় আনা উচিত। তিনি বলেন, ‘(শাস্তি প্রসঙ্গে) অবশ্যই দেওয়া উচিত। সবার জানা উচিত, কেমন করে কী হয়েছে। এটা দেশের বড় সম্পদ। টাকাপয়সা যে আসা শুরু করল, এটা এই ক্রিকেট বোর্ডের কারও কৃতিত্ব না। এটা আইসিসি বা এসিসি থেকে আসে। ক্রিকেট বোর্ড যে এটার জন্য অনেক মেহনত করেছে, তা-ও নয়। এটা (মেহনত) কিন্তু আগেই হয়ে গেছে। সেই টাকাটা ঠিকমতো ব্যয় করা হয়নি। কারণ, সেভাবে তো ক্রিকেটের উন্নতি হয়নি।’
গতকাল ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ঘোষণা দিয়েছেন, এত দিন যারা দুর্নীতিতে জড়িতে ছিলেন, তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে, ‘যেখানে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ আছে, এ বিষয়গুলো তদন্ত করব। এবং যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। যে গঠনতন্ত্র আছে, ফেডারেশন আছে, সেটা যেন গণতান্ত্রিক হয়। একনায়কতন্ত্রের চর্চার যেন সুযোগ না থাকে, সেগুলো পুনর্গঠনের চিন্তাভাবনা আছে।’
আপনার মতামত লিখুন :